ইফতারিতেও মূল্যস্ফীতির থাবা
পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের রেস্তোরাঁ মালিক শফিক আলাউদ্দিন। অন্যান্য বছরের মতো এবারও ইফতারির আইটেম হিসেবে হালিম বিক্রি করবেন তিনি। তবে গত বছর ২০০ টাকায় যে পরিমাণ হালিম দিয়েছেন, এবার সেই একই দামে হালিমের পরিমাণ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে অনেকটাই। তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সমন্বয় করতেই হালিমের পরিমাণ কমিয়ে আনার এই সিদ্ধান্ত।
আলাউদ্দিন বলেন, 'হালিম তৈরির বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়েছ। ফলে জনপ্রিয় এই খাবারটির দাম এভাবেই সমন্বয় করতে হবে। তা না হলে অনেকেই খেতে পারবে না।'
এবার শুধু হালিম নয়, বেগুনি, পিঁয়াজু, ছোলা, জিলাপি, মুড়ি, কাবাব, গরুর মাংসের বিভিন্ন মুখরোচক খাবারসহ বিভিন্ন সাধারণ মানের ইফতারি আইটেমের দাম বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা। এছাড়া এলাকাভিত্তিক যত মুখরোচক খাবার রয়েছে সেগুলোর দামও বৃদ্ধি পাবে।
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা জানান, এবারে এমন সময় রোজা শুরু হচ্ছে, যখন খাদ্য ও খাদ্যপণ্য তৈরির উপাদানগুলোর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার চড়া। আয়ের তুলনায় নিত্যপণ্যের চড়া দামের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়ে ভোক্তারা এখন তাদের ব্যয় কাটছাঁট করছেন।
এ পরিস্থিতিতে রেষ্টুরেন্টগুলোতে ইফতার তৈরির যথেষ্ট আয়োজন থাকলেও খাবারগুলোর দাম বেড়ে যাবে। দাম বেড়ে গেলে ইফতারকেন্দ্রিক ব্যবসা কতটা জমবে, তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা আল-আমিন ৫ জনের সংসারের খরচ চালান বেসরকারি চাকরি করে। বেতন ৩০ হাজার টাকা হলেও বেশিরভাগই চলে যায় বাসাভাড়ায়। এছাড়া বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ওষুধ, ৭ বছরের সন্তানের খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ সবকিছুর দাম বেড়ে গেলেও তার বেতন আগের জায়গায় রয়েছে।
আল আমিন বলেন, 'টিসিবি ট্রাক থেকে আমার স্ত্রী গিয়ে তেল, চিনি, পেঁয়াজ কিনে আনেন। নিয়মিত খাওয়ার খরচ নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছি তখন আমার মতো মানুষের বাইরে থেকে ইফতার কিনে খাওয়ার বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ কম।'
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা জানান, ইফতারের জন্য বিভিন্ন আইটেম তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আছে তাদের। তবে বিক্রি আগের মতো হবে কি না, সে ব্যাপারে কিছুটা সংশয় রয়েছে। কারণ এক শ্রেণীর মানুষের কাছে টাকা রয়েছে, তারা হয়তো খাওয়া কমাবে না। কিন্তু যাদের হাতে টাকা কম অনেকেই হয়তো আর বাইরে ইফতার কিনতে আসবে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, 'ইফতার তৈরির বিভিন্ন উপাদানের দাম বেড়েছে। যে কারণে ইফতারের বিভিন্ন খাবারের দাম বাড়বে। অন্যদিকে যখন জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই মানুষ বেকায়দায়, তখন দাম বাড়ানো হলে ইফতারের ব্যবসা কতটা জমে উঠবে তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।'
দিলু রোডের বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের ম্যানেজার নজরুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, বিভিন্ন উপাদানের দাম বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যেই জিলাপির কেজি ২০০ টাকা থেকে ২৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রোজায় সেটা আরও একটু বাড়তে পারে।
'পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ যেগুলো গত বছর ৫ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে, সেগুলো হয়তো আকারে ছোট করে দাম ঠিক রাখা হবে, অথবা আকার ঠিক রেখে দাম ৭-৮ টাকা করা হবে,' বলেন তিনি।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী শফিক আলাউদ্দিন বলেন, 'গত বছর জালি কাবাব বিক্রি করেছি ৩৫ টাকায়, এবার সেটা আরও বেশি দামে বিক্রি করতে হবে। কারণ গরুর মাংসের কেজি ৬০০ টাকা থেকে বেড়ে এবার ৭৫০ টাকায় উঠেছে।'
দেশে ইফতারের ব্যয় নিয়ে তেমন কোনো জরিপ বা গবেষণা নেই। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্যও নেই রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের কাছে। তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকার ড. মামুন রশীদ ২০১৪ সালে ইফতারের অর্থনীতি নিয়ে একটি জরিপ করেছিলেন। ওই জরিপের সঙ্গে দেশের মানুষের বর্তমান সময়ের মূল্যস্ফীতি ও মানুষের ব্যয় কাঠামো মিলিয়ে একটি আর্থিক লেনদেনের একটি চিত্র তুলে ধরা যায়।
ওই জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে বর্তমানে দেশে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশ মুসলমান। প্রতিদিন অন্তত ১২ কোটি মানুষ ইফতার করেন। কেউ খরচ করেন ১০০ টাকা, কেউ আবার ২০ টাকা। একজন মানুষ গড়ে ৪০ টাকা খরচ করলে প্রতিদিন খরচ হয় ৪৮০ কোটি টাকা। এক মাসে এ খরচের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৪০০ টাকায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বছর নির্দিষ্ট আয়ের মানুষগুলোর বেশ খানিকটা কষ্টই হবে। অনেকেই হয়তো ৪০ টাকাও খরচ করতে পারবেন না। কারণ আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি বেড়ে গেছে।
কারওয়ানাবাজারের কাঠমিস্ত্রি সোহেল রানা। তিনি ১২ হাজার টাকা বেতনে ফার্নিচারের দোকানে চাকরি করেন। স্ত্রীসহ একরুমের বাসা ভাড়া দিতে হয় তাকে ৫ হাজার টাকা, গ্রামে বাবা-মাকে মাসে ২ হাজার টাকা পাঠিয়ে বাকি টাকায় খাওয়া-দাওয়াসহ সংসার চালাতেন। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় তিনি খাবার মেনুতে ইতোমধ্যেই অনেক কাটছাঁট করে ফেলেছেন।
নির্দিষ্ট আয়ের অনেক মানুষই এখন এমন দুরাবস্থায় আছেন।