জাতিসংঘ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ঢাকাকে পাশে চায় মস্কো
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তাদের অন্য মিত্র দেশগুলোর আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশের সমর্থন চেয়েছে রাশিয়া।
একইসঙ্গে, রাশিয়ান ফেডারেশনে আগামী জুনে অনুষ্ঠিতব্য সেন্ট পিটার্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরামে ঢাকার যোগদান চায় মস্কো। এছাড়া বৈশ্বিক হিরা শিল্পের পর্যবেক্ষক সংস্থা- কিম্বার্লি প্রসেস থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার পশ্চিমা উদোগের বিপক্ষেও বাংলাদেশের সমর্থন চেয়েছে দেশটি।
জুনের ১৫-১৮ তারিখের সেন্ট পিটার্সবার্গ ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ফোরামে অংশ নিতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একজন উপদেষ্টা অ্যান্টন কোবায়েকভ।
পশ্চিমা দেশগুলোর আরোপিত নানান প্রকার নিষেধাজ্ঞা যখন রাশিয়াকে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে, এমন সংকটের মুহূর্তে সম্মেলনটির আয়োজন করছে রাশিয়া।
অ্যান্টন কোবায়েকভ চিঠিতে লিখেছেন, "আমি আস্থা রাখি, আপনাদের ২০২২ সালের কর্ম-পঞ্জিকায় আসন্ন ফোরামটিকে অগ্রাধিকার দেবেন। আপনাদের অংশগ্রহণ যেন অত্যন্ত ফলদায়ক হয় সেজন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। থাকবে দ্বিপাক্ষিক নেটওয়ার্কিং, মতামত বিনিময়, নতুন চুক্তি আলোচনা ও নতুন বিনিয়োগ চুক্তি সইয়ের অবারিত সুযোগ।"
এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার প্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১৩টি দেশ রাশিয়া ও বেলারুশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোনো দেশের উপর এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা ডব্লিউটিওর 'মোস্ট ফেভার্ড ন্যাশন' নীতির পরিপন্থী হলেও, নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের সমর্থক দেশগুলোর এক যৌথ বিবৃতি গত ১৫ মার্চ জারি করেছে বিশ্ব বাণিজ্য সহজীকরণে গঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।.
ডব্লিউটিওতে ঢাকার সমর্থন চায় রাশিয়া:
ডব্লিউটিও-তে রাশিয়ান ফেডারেশনের পাঠানো একটি যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে, বাংলাদেশকে দেওয়া রাশিয়ার চিঠিতে বলা হয়েছে, "আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থার মধ্যে রাশিয়ান ফেডারেশনের অধিকার ও বৈধ স্বার্থ সীমিত করা অগ্রহণযোগ্য, তাই রাশিয়ান পক্ষ বাংলাদেশিদের প্রতি সমর্থনের আহ্বান জানাচ্ছে। এরমধ্যে ডব্লিউটিও-তে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখাকেও সমর্থনের অনুরোধ রয়েছে।"
রাশিয়া আরও বলেছে, ডব্লিউটিও থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কার করা অথবা সদস্যপদ স্থগিত রাখার প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে, যা হবে সংস্থাটির নিয়মবিরুদ্ধ।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাশিয়ার পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে 'মোস্ট ফেভার্ড ন্যাশন' মর্যাদা প্রত্যাহার এবং তা পুনর্বহালের বিষয়ে কোনোপ্রকার আলোচনার সুযোগও না রাখা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অ-বৈষম্যের মৌলিক নীতি ভঙ্গ করেছে।
"আমরা যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেওয়ার হিংসাত্মক দুষ্টচক্র চালিয়ে যেতে থাকি, তাহলে সংস্থার সকল সদস্যই এক পর্যায়ে প্রভাবিত হবে, যার ফলে ডব্লিউটিওর চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন বিক্ষিপ্ত এবং পরিশেষে ন্যূনতম হয়ে পড়বে।"
'নিরাপত্তা স্বার্থ' রক্ষার অঙ্গীকার ডব্লিউটিওর:
১৫ মার্চ ডাব্লিউটিও থেকে জারি করা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, নর্থ মেসিডোনিয়া, নিউজিল্যান্ড, মন্টিনিগ্রো, মালদোভা, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, আইসল্যান্ড, ইইউ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, "আমাদের অপরিহার্য নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার জন্য আমরা ডব্লিউটিও সদস্য হিসেবে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এর মধ্যে ইউক্রেনের সমর্থনে কর্মকাণ্ড, বা রাশিয়ার বিষয়ে ছাড় বা অন্যান্য বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার মতো পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। যেমন রাশিয়ান ফেডারেশনের পণ্য এবং পরিষেবাগুলির ক্ষেত্রে 'মোস্ট ফেভার্ড ন্যাশন' মর্যাদা স্থগিত করা।"
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো পৃথক এক নোট ভার্বাল চিঠিতে ঢাকাস্থ রাশিয়ান দূতাবাস বলেছে, ইইউ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার প্রতিনিধিরা কিম্বারলি প্রসেসে রাশিয়ান ফেডারেশনের অংশগ্রহণের স্তরকে কমিয়ে আনতে চাইছে। কানাডা "জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা"কে অনুপযুক্তভাবে উল্লেখ করে, সংস্থাটির পার্টিসিপেশন অ্যান্ড চেয়ারম্যানশিপ এবং নিয়ম ও পদ্ধতি সংক্রান্ত কমিটিতে রাশিয়াকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও রাশিয়ার সভাপতিত্বে ওই কমিটি দুটিতে অংশ নিতে অস্বীকার করেছে।
রাশিয়ান হীরার কেপি কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিত কিনা তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো প্রশ্ন তুললে তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা চেয়েছে মস্কো।
রাশিয়া উল্লেখ করে, কিম্বার্লি প্রসেস সিভিল সোসাইটি কোয়ালিশন, একটি পক্ষপাতদুষ্ট আমেরিকানপন্থী এনজিও। তারা প্রকাশ্যে রাশিয়ান হীরাকে সংঘাত অঞ্চলের হীরক হিসেবে লেভেলিং করার চেষ্টা করছে। এই ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
নোট ভার্বালে আরও বলা হয়েছে যে, রাশিয়ান পক্ষ বাংলাদেশী পক্ষকে কেপি প্রয়োজনীয়তার সাথে রাশিয়ান হীরার কমপ্ল্যায়েন্স নিয়ে প্রশ্ন তোলার পশ্চিমা দেশগুলির প্রচেষ্টার বিরোধিতা করার আহ্বান জানিয়েছে। এই ধরনের নজির, রাজনৈতিক অজুহাতে সদস্য রাষ্ট্রগুলির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে চাপ দেওয়ার অন্যায় অনুশীলনের আরও বিস্তার ঘটাতে পারে।
"বৈশ্বিক প্রাকৃতিক হীরা খাতের যে কোনো ক্ষতিতে প্রভাবিত হবে এশিয়া এবং আফ্রিকার কয়েক মিলিয়ন-জনসংখ্যা, যাদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে শুধুমাত্র লাভবান হবে, আনুমানিক মূল্য নির্ধারক আমেরিকান প্রস্তুতকারক ও কৃত্রিম হীরার ব্যবসায়ীরা।"
মস্কো বলেছে, বৈশ্বিক হীরা খাতে কৃত্রিম অস্থিতিশীলতা এড়াতে, বাংলাদেশি পক্ষ যদি জাতীয় সংস্থাগুলিকে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক ফরম্যাটে রুশ বাণিজ্য সংস্থাগুলিকে সমর্থন করার জন্য উৎসাহিত করে, তাহলে রাশিয়ান পক্ষ অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হবে।
রাশিয়ার বিরোধিতাকারী দেশগুলোর দখলে ঢাকার রপ্তানি বাজারের ৭০ শতাংশ
ডব্লিউটিওতে রাশিয়ার বিপক্ষে যেসব দেশ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে, সেগুলোই বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজার। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও জাপান থেকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি সব দেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ তুলে র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করছে ঢাকা।
অন্যদিকে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বড় সমর্থক ছিল রাশিয়া। দেশটি মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যাপক সহায়তা করেছিল। এছাড়া, যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম বন্দর সচল করতে মাইন অপসারণ করার সময় রাশিয়ানদের প্রাণ দিতে হয়েছে।
ইউক্রেন আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে নিন্দা জানানোর জন্য তোলা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও চীনসহ ৩৫টি দেশের ভোটদানে বিরত ছিল।
ঢাকার নিরপেক্ষ অবস্থানকে অগ্রহণযোগ্য বলছে যুক্তরাষ্ট্র
এরপর গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত অংশীদারিত্ব সংলাপে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের 'নিরপেক্ষ' অবস্থানকে 'অগ্রহণযোগ্য' উল্লেখ করে বলে, এখন নিরপেক্ষ থাকার সময় নয়।
সংলাপের পর ইউক্রেনে মানবিক সংকট নিরসনের দাবিতে উত্থাপিত অপর এক প্রস্তাবের সমর্থনে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত ৩০ মার্চ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, 'রাশিয়া আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে যখন পাকিস্তানের পক্ষে, রাশিয়া তখন আমাদের পক্ষে দাঁড়াল। কাজেই দুঃসময়ে যারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে আমরা নিশ্চয় তাদের পাশে থাকব।
'কিন্তু তারা যদি কোনো অন্যায় করে, নিশ্চয় সেটা আমরা মানব না। আর আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু যুদ্ধটা বাধাল কারা, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। সেজন্য আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। রেজোল্যুশনটি যেহেতু যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য নয়, বরং একটি দেশের বিরুদ্ধে, এজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ভোট দেব না।'
রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মোল্লা সালেহীন সিরাজ গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে বলেছেন, রাশিয়া পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করার পর এবং অবন্ধুসুলভ মনে করে না এমন অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করার সম্ভাবনা থাকলে বাংলাদেশের কিছু সুযোগ থাকতে পারে। সেইসঙ্গে রাশিয়ার বাজারে বিভিন্ন পণ্যের বিকল্প উৎসও খুলতে চাইবে।
এই সময়টাকে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। পশ্চিমা দেশগুলোকে বিরক্ত না করে কৌশলে নিজ স্বার্থ নিয়ে এগোতে পাআরে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করা।