পাম তেলের ঘাটতি, দাম বাড়ছে প্যাকেটজাত খাদ্যের
- ২৮ এপ্রিল থেকে পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করেছে ইন্দোনেশিয়া
- দেশের চাহিদা ৮০ শতাংশ আসে ইন্দোনেশিয়া থেকে
- ৫-১০ শতাংশ দাম বেড়েছে সেমাই, পাস্তা, নুডলসসহ বেকারি পণ্যে
- দাম বাড়বে চানাচুর, বিস্কুট, কসমেটিকসসহ প্যাকেটজাত সব খাদ্যে
- ৪-৫ দিন পর্যন্ত তেল মজুদ থাকে ফুড উৎপাদকদের
- সানফ্লাওয়ার, রাইস ব্র্যান অয়েল, সরিষার তেল ও মালয়শিয়ান পাম তেলে বিকল্প ভাবনা
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের পর ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করার পর ঝুঁকিতে পড়েছে বিস্কুট, নুডলস, পাউরুটি, সেমাইসহ প্যাকেটজাত খাবার, বেকারি ও কসমেটিকস পণ্যের উৎপাদন।
ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার না করলে প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে পাম তেলের বিকল্প পাওয়া নিয়েও শঙ্কার কথা বলছেন তারা ।
দেশের খাদ্যপণ্যের অন্যতম উৎপাদক আকিজ ভেঞ্চারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সৈয়দ আলমগীর বলেন, 'ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রির বড় একটি কাঁচামাল পাম অয়েল। বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ পাম অয়েলের যোগানদাতা ইন্দোনেশিয়া। কম দামে ওখানকার তেল কিনতে পারতো দেশ। তারা রপ্তানি বন্ধ করায় এখন মালয়েশিয়া থেকে বেশি দামে আমদানি করতে হবে'।
তিনি বলেন, 'মালয়েশিয়ান পাম তেল থাকার কারণে দাম বাড়লেও আমরা এখনো সংকটে পড়িনি। তবে খুচরা বাজারে তেলের যেভাবে সংকট তৈরি হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়া সবসময়ই রপ্তানি বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার না করলে তা আমাদের পর্যন্ত চলে আসবে'।
গমের বিষয়ে তিনি জানান, দাম ও মানের সমন্বয়ে ইউক্রেনের গম উপযোগী ছিল। এটা বন্ধ হওয়ার পর ভালো মানের গম আনতে হচ্ছে কানাডা থেকে। কানাডার গমের দাম অনেক বেশি। জ্বালানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া বেড়েছে, এ কারণে এই উপকরণের খরচ বেশ বেড়েছে। আমরা ঈদের আগে সেমাইসহ বিভিন্ন প্রসেস ফুডের দাম ৫ শতাংশ এবং কোন কোনটায় আরও একটু বেশি বাড়াতে বাধ্য হয়েছি।
ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে গত শুক্রবার, যা কার্যকর হয়েছে ২৮ এপ্রিল থেকে। তবে দেশের বাজারে এর মধ্যেই তেলের সংকট তৈরি হওয়ার পাশাপাশি দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ভোজ্যতেল প্রডিউসিং কোম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। বাজারে সরবরাহ না থাকায় দোকানগুলো তেলশূণ্য হয়ে পড়েছে।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারসহ বিভিন্ন পাইকারি-খুচরা বাজার ও সুপারশপগুলোতে ঘুরে তেল সংকট দেখা গেছে। সরবরাহ কমে যাওয়া মুদি দোকানগুলো বিক্রি সীমিত করতে শুরু করেছেন।
কারওয়ানবাজারের রিফাত স্টোরের মালিক রিফাত হোসাইন বলেন, 'প্রতিদিন আমার দোকান থেকে দুই ড্রাম (প্রতি ড্রামে ২০৪ লিটার তেল) পাম তেল বিক্রি হয়। তিনদিন ধরে সাপ্লাই না থাকায় এক ড্রাম সীমিত আকারে গ্রাহক প্রতি অল্প অল্প করে বিক্রি করছি'।
তিনি বলেন, 'কিছু পরিচিত হোটেল ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা তেলের সঙ্গে অন্য পণ্যও কিনেন, শুধু তাদের কাছেই কম কম করে তেল বিক্রি করছি। কিন্তু এটা শেষ হলে নতুন তেল কবে পাবো তা বলতে পারছি না'।
মধ্য বাড্ডার খুচরা ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, একদিনের ব্যবধানে ড্রামে দেড় হাজার টাকা বাড়তি দাম চাওয়া হচ্ছে।
দুই দিনের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সেমাইয়ের দামও বেড়েছে। ২০০ গ্রাম ওজনের যেসব প্যাকেটজাত সেমাই আগে ৩৫ টাকা ছিল সেগুলো শুক্রবার ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০ টাকার নুডলস প্যাক বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকায়। গলির দোকানে বিক্রি হওয়া ৫০ টাকার পাউরুটি প্যাক এরই মধ্যে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকায় উন্নীত হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রপ্তানি আদেশ প্রত্যাহার না হলে প্যাকেটজাত খাবারের দাম আরো বাড়াতে হবে বলে জানিয়েছেন বেকারি, বিস্কুট বা স্ন্যাকস আইটেম প্রস্তুতকারীরা ।
দেশের শীর্ষ খ্যাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক চৌধুরী কামরুজ্জান কামাল বলেন, 'গমের দাম বৃদ্ধির পর আমরা প্রফিট কমিয়ে ভোক্তাদের হাতে পণ্য দিয়েছি। এখন পাম অয়েল আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাই ঝুঁকিতে পরে যাবে। ইন্দোনেশিয়ার বিকল্প অন্য দেশ থেকে আমদানি হলেও তার দাম পড়বে অনেক বেশি। ফলে একটি সংকট অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য'।
ফুড কোম্পানিগুলো নিজেরা সরাসরি আমদানি না করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা সাধারণত থার্ড পার্টির মাধ্যমে তেল সংগ্রহ করি। আমাদের স্টক তেল দিয়ে সাধারণত ৪-৫ দিনের প্রোডাকশন অব্যাহত রাখা যায়'।
তবে পাম তেল না পেলে ফুড উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাবে তা বলতে রাজি নন এসিআই এগ্রোবিজনের প্রেসিডেন্ট ও কৃষিবিদ এ এফ এম আনসারি।
তিনি বলেন, 'পাম তেল দামে সস্তা। কিন্তু এর বিকল্প সানফ্লাওয়ার তেল রয়েছে। ক্যারোনা অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েল, রেপসিট অয়েল ও সরিষার তেলের মতো বিকল্প রয়েছে। এসবের দাম একটু বেশি। তবে খুব বেশি ক্রাইসিস হবে না'।
'পাম তেল বন্ধ হলে আমাদের সরিষার তেল উৎপাদনে জোর দিতে হবে,' উল্লেখ করেন তিনি।
মালয়শিয়াতে দাম বাড়ছে, বৈশ্বিক সরবরাহ সংকট তৈরির শঙ্কা
পাম তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া। দেশটির রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার খোঁজ নেওয়া হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ মালয়শিয়ায়। দুটি দেশ মিলে বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের ৮৬ শতাংশ সরবরাহ করে।
ইন্দোনেশিয়া পাম তেলের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় মালয়শিয়ান পাম তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ সংকটের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করেছে মালয়শিয়াস্থ বাংলাদেশি দূতাবাস।
দূতাবাসের কাউন্সেলর (বাণিজ্যিক) মো. রাজিবুল আহসান গত রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি চিঠি পাঠান। এতে মালেয়শিয়ান তেল মজুদের চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
এই চিঠিতে বলা হয়, গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশটিতে ১.২৬ মিলিয়ন টন পাম তেল উৎপাদন হয়েছে। যা ২০২১ সালের একই সময়ে ছিল ১.৬০ লাখ টন। ২০২১ সালে যে তেলের দাম মালয়শিয়াতে ৪ হাজার রিঙ্গিত রয়েছে, তা এ বছরের একই সময়ে ৮ হাজারে পৌঁছেছে।
কাউন্সেলর মো. রাজিবুল আহসান চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশ জানুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত সময়ে রেকর্ড পরিমাণ তেল আমদানি করেছে। এই সময়ে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ৮৮,১৮৫ মে টন পাম অয়েল আমদানি করেছে বাংলাদেশ।
টিকে গ্রুপের পরিচালক মো. সাইফুল আতহার তাসলিম বলেন, 'মালয়শিয়াতে এখনো পাম তেল পাওয়া যাচ্ছে। তবে দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। সব দেশ একেবারে মালয়েশিয়ার দিকে ঝুঁকলে তখন কী হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না'।