পাস্তুরিত দুধ: খামারী দুধের দাম পায় না, ভোক্তা কিনে বেশি দামে
ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফার মার্জিন বেড়েছে। কিন্তু খামারী পর্যায়ে মূল্য সেভাবে না বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের লোকসান বেড়েছে।
খামারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রাণী খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় গত এক বছরে গাভী পালনে খরচ বেড়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে দুধের দাম বাড়েনি।
কোম্পানিগুলো খামারীদের কাছ থেকে বেশি মূল্যে দুধ কিনতে চায় না। আবার প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ক্রেতা হওয়ায় তাদের কাছে বিক্রি না করেও খামারীদের উপায় নেই।
পাবনার ভাংগুরা থানার গো-খামারী খোকন বিশ্বাস ৪টি গাভি পালন করেন। প্রতিদিন তিনি দুধ বিক্রি করেন ৬০ লিটার। তিনি নিজের ও আশপাশের গ্রামের ১০০ খামারীর কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে প্রতিদিন আড়ং ডেইরির কাছে বিক্রি করেন।
তিনি জানান, এখন গো খাদ্যের দাম এমন পর্যায়ে গেছে যে গাভী পালনই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। খাদ্যের দাম দ্বিগুণ হলেও সে অনুপাতে বাড়েনি দুধের দাম। গত এক বছরে দুধের দাম বেড়েছে দুই দফায় ১.৫-১.৭৫ টাকা।
জানা যায়, আড়ং ডেইরি প্রতি আধা লিটার দুধের দাম ৭ টাকা বাড়িয়ে ৪৫ টাকা এবং ১ লিটারে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছে। যেখানে খামারী পর্যায়ে দুই দফায় দুধের দাম ১.০৫ টাকা থেকে ১.৭৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, বলে জানান একাধিক খামারী। যদিও প্রতিষ্ঠানটির দাবি তারা গত এক বছরে খামারী পর্যায়ে দুই দফা দুধের দাম বাড়িয়েছে ৪.৫০ টাকা।
ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেস এর সিনিয়ন ডিরেক্টর মো. আনিসুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা এক বছরে দুই দফায় কৃষক পর্যায়ে দুধের দাম বাড়িয়েছি। এখন প্যাকেজিং, পরিবহন, বিতরণে খরচ বেড়েছে। যে কারণে দাম বাড়াতে হচ্ছে।'
এছাড়া প্রসেসিং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল যেমন প্যাকেজিং, কার্টনসহ বেশকিছু জিনিসের দাম ১৫-৪০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়াও কয়েক মাস আগে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন এবং বিতরণ খরচ বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
আড়ং ছাড়াও মিল্ক ভিটা, প্রাণ, আকিজের মত লিডিং কোম্পানিগুলিও দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেছে।
মিল্কভিটার এক কর্মকর্তা জানান, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের কাছে তরল দুধের দাম ১০ টাকা বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুগ্ধজাত পণ্যের দাম ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
মিল্কভিটার একটি সূত্র বলছে, খামারীদের দুধে সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া যায় কিনা এ বিষয়ে মিল্ক ভিটা একটা প্রস্তাবনা তৈরির কাজ করছে। যেখানে মিল্ক ভিটা যে দামে দুধ কিনবে সে দামের বাইরে আরও ১০ টাকা সরকার থেকে ভর্তুকি দেওয়া হবে।
মিল্কভিটার উপ-সচিব ও মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন, অর্থ ও নীরিক্ষা) ডা. মো. মাহফুজুল হক টিবিএসকে বলেন, আমরা খামারীদের ভর্তুকি দেয়া যায় কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করছি। এটা নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
পাবনার কয়েকজন খামারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খৈল ও ভুসি কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি দরে। ভুট্টা কিনে ভাঙানো পর্যন্ত দাম পড়ছে ৪৮-৪৯ টাকা। যে পণ্যগুলোর দাম আগে ছিল ২৫-৩০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশনের শাহ এমরান টিবিএসকে বলেন, 'গমে ভুসির দাম এক বছর আগে ছিল ১১০০-১২০০ টাকা (৫০ কেজির বস্তা), যা এখন কিনতে হচ্ছে ২০৫০ টাকায়। এভাবে সব খাদ্যের দামই ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু খামারীদের দুধের দাম বাড়ে না।'
তিনি বলেন, 'একদিকে খামারী ঠকছে, অন্যদিকে ব্যপকভাবে প্রসেসড মিল্কের দাম বৃদ্ধিতে চাপে পড়ছে ভোক্তারা। খামারিদের দুধের দাম নিয়ে সরকারের একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা দরকার।'
খামারী ও প্রসেসিং কোম্পানিগুলোর তথ্য বলছে, কাচা দুধের দাম নির্ধারণ করা হয় মূলত ফ্যাটের পরিমাণের উপর। দুধে ৪ শতাংশ ফ্যাট থাকলে আড়ং লিটার প্রতি ৩৮.৫৫ টাকা দিচ্ছে খামারীদের।
খামারীদের কাছে সাধারণত সা ৪-৪.৫ শতাংশ ফ্যাটযুক্ত দুধই বেশি পাওয়া যায়। যার সর্বোচ্চ দাম পড়ছে ৪৩ টাকা। অন্যদিকে বেশি ফ্যাটযুক্ত যেমন ৫.৫-৭ শতাংশ দুধের দাম ৫১.৯০-৬৫.২৫ টাকা। তবে এই মাত্রায় ফ্যাটযুক্ত দুধ পাওয়া যায় শতকরা দুই-তিনজন খামাড়ির কাছ থেকে।
খামারীরা বলছেন, বেশিরভাগ দুধের দামই এখন ৪০-৪৫ টাকার মধ্যে। অন্যদিকে গ্রামের বাজারগুলোতে দুধ বিক্রি হয় ৫৫-৬০ টাকার মধ্যে। কিন্তু এত দুধ একসঙ্গে বাজার বিক্রি করার ক্রেতা নেই। যে কারণে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখানে নিয়মিত দুধ বিক্রি করা যায়। কিন্তু সংকট একটাই, ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আয় হচ্ছে না।
এদিকে সমবায় ভিত্তিতে পরিচালিত হয়ে আসছে মিল্কভিটা। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন প্রায় ১.৫ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে খামারীদের কাছ থেকে। এই প্রতিষ্ঠানের খামাড়িরা দীর্ঘদিন ধরেই দুধের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে কারণে খামারীরা এখন আর মিল্ক ভিটায় দুধ দিতে চাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে মিল্কভিটার এক কর্মকর্তা বলেন, খামারীদের কাছ থেকে আশানুরুপ দুধ সংগ্রহ করা যায়নি। তাই এই বছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসান করতে পারে।
এদিকে দাম বৃদ্ধির বিষয়ে প্রাণের কর্মকর্তারা অফিসিয়ালি কোন বক্তব্য দিতে চান না। যখন নতুন দাম কার্যকর করবে তখনই মিডিয়ার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন।
উল্লেখ্য, প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ডেইরি খামারীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি টন দুধ উৎপাদন হচ্ছে।
এর মধ্যে হাতে প্রথম সারির কয়েকটি মিল্ক প্রসেসিং কোম্পানিগুলো ৭-৭.৫ লাখ টন দুধ প্রসেসিং করে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য প্রস্তুত করছে। যা উৎপাদিত দুধের মাত্র আড়াই শতাংশ।