সিরাজগঞ্জে শতকোটি টাকার দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার, তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তা
কলকাতার জোড়াসাঁকোর কয়েকজনের কাছ থেকে হোয়াটসঅ্যাপে ঘোল আর মাঠার অর্ডার পেয়ে অবাক হয়ে যান সিরাজগঞ্জের সলপ এলাকাবাসী আব্দুল খালেক।
বছর খানেক আগে, জোড়াসাকোর এই পর্যটকেরা বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় আব্দুল খালেকের দোকান থেকে স্থানীয়ভাবে 'ঘোল' ও 'মাঠা' নামে পরিচিত বাটারমিল্ক খেয়েছিলেন। এরপর তাদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয় ঘোল-মাঠার ব্যবসায়ী আব্দুল খালেকের। জোড়াসাকোর ওই পর্যটকেরা সলপ এলাকার ঐতিহ্যবাহী ঘোল-মাঠা পণ্যের ব্যবসা করতে চান ভারতে। মাসে কয়েক টন চাহিদাও রয়েছে তাদের।
কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ দিতে পারছেন না খালেক। কারণ দেশেই সরবরাহ করে কূল পান না এই উদ্যোক্তা।
দেশীয় বাজারে ঘোল, মাঠা, দই আর ঘি তৈরিতে প্রতিদিন ১০০ মণ দুধ লাগে জানিয়েছে খালেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মাসে অন্তত ১ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয় আমার দোকানেই।"
জানা যায়, সলপে বর্তমানে ১০ থেকে ১২টি ঘোল আর মাঠার দোকান গড়ে উঠেছে। বাজারে বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ঘোল আর মাঠার ব্যবসা হয়। এখানে কর্মসংস্থানও হয়েছে শতাধিক মানুষের।
জেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তরের তথ্য মতে, সিরাজগঞ্জে ছোট-বড় প্রায় ৩৩ হাজার গবাদিপশুর খামার রয়েছে। এসব খামারে গবাদিপশু রয়েছে ১৫ লাখেরও বেশি— যার প্রায় অর্ধেকই গাভী। জেলায় প্রতি বছরে প্রায় ৭ লাখ ১৬ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়।
বাঘাবাড়ি মিল্ক ভিটা, আড়ংসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দুগ্ধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দৈনিক প্রায় ৩ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করেন। প্রতি লিটার দুধ গড়ে ৫৫ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। সেই হিসাবে দৈনিক বিক্রি দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ওপরে।
সিরাজগঞ্জে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনের ইতিহাস ১০০ বছরের বেশি উল্লেখ করে আইএসও সনদ পাওয়া দোকানের মালিক আব্দুল খালেক জানালেন, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় সলপ রেলওয়ে স্টেশনে শতবছর আগে তার দাদা রাজশাহী থেকে ঘোষ-মাঠা তৈরি করা শেখেন। এরপর বাবার হাত ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন আব্দুল খালেক ও তার ভাই আব্দুল মালেক। দুজনের প্রতিষ্ঠান এখন আলাদা। উন্নত মানের পণ্য তৈরিতে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ও সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ, সহায়তা আরও ঋণও দেওয়া হয়েছে।
খালেক ও মালেক মিলে মাসে অন্তত ২৪ কোটি টাকার ঘোষ, মাঠা, দই আর ঘি বিক্রি করেন। দুই দোকান মিলে প্রায় ৫০ জন মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছে।
খালেক জানালেন, "আমাদের মাঠা ও ঘোলের চাহিদা ভারতের মালদাহ, গৌরি, শিলিগুড়িতে ব্যাপক। কিন্তু দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন বাইরে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।"
নারী খামারিদের ভূমিকা
দুধের বহুমুখী পণ্যের বাজার উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিরাজগঞ্জসহ দেশের ১২টি জেলায় আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ), পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ও ডেনিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (ডানিডা) অর্থায়নে রুরাল মাইক্রোএন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রোজেক্ট (আরএমটিপি)-এর মাধ্যমে কাজ করছে।
এতে ২০১,৪৮০ খামারি ও উদ্যোক্তাকে নানাবিধ কারিগরি, প্রযুক্তি ও বিপণনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দুধের বাজার, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে কাজ করছে তারা।
পিকেএসএফ কর্মকর্তারা জানান, পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে জেলায়। প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে আয় বাড়ছে উদ্যোক্তাদের। গ্রামীণ দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্র (ভিএমসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব বাসস্থান, দূষণ রোধ, বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি দিয়ে উদ্যোক্তাদের সহায়তাও করা হয়েছে। এতে জেলায় বছরে ১০০ কোটি টাকার ওপরে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি হচ্ছে।
এই উপপ্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক লাখ মানুষের ব্যবসা প্রসার ও আয় বৃদ্ধি হয়েছে উল্লেখ করে পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নমিতা হালদার বলেন, "এখন দুগ্ধজাত দেশীয় পণ্যের বাজার ক্রমেই বাড়ছে। উদ্যোক্তারা তাদের পণ্য বিদেশেও রপ্তানি করছেন। এতে সমৃদ্ধ হচ্ছে জাতীয় অর্থনীতি। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী এ খাতের ইতিবাচক প্রভাব ঘটানো সম্ভব হতে পারে। আগামীতে তাদের আরও সহায়তা করা হবে।"
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সহায়তার ফলে অর্থনৈতিক এই গতিশীলতার সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছেন জেলার খামারিরা। তাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। তারা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণের পর বাড়িতেই গরু পালন শুরু করেন।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার সলপ ইউনিয়নের মো. হাসি খাতুন তাদের মধ্যেই একজন। তার বাড়ির উঠানে গড়া খামারে উন্নত জাতের ৬টি গরু ছিল। কিছুদিন আগে ৩টি বিক্রি করেছেন। এখন ৩টি রয়েছে। একটি থেকে দিনে ১২ লিটার দুধ পান তিনি।
হাসি জানান, "আগে গরু পালনের সময় দেখেছি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতো। কিন্তু আমি এনডিপির আরএমটি প্রকল্পের প্রশিক্ষণের পর শিখেছি কীভাবে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গরু লালন-পালন করতে হয়। কোন পদ্ধতিতে গরু পালন করলে নিরাপদ দুধ পাওয়া যায়। এখন বাজারে গিয়ে আর দুধ বিক্রির জন্য বসে থাকতে হয় না। ব্যবসায়ীরা খোঁজ নিয়ে দুধ কিনে নেন।"
সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউনিয়নের ভারাঙ্গা গ্রামের তাপসী খাতুন (২৬), অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় একই গ্রামের গার্মেন্টসকর্মী সাহেব আলীর সাথে তার বিয়ে হয়। এক পর্যায়ে বাড়িতে ফিরে তাপসী গরুর ২টি বকনা বাছুর ও কিছু হাঁস-মুরগী কেনেন। খামার বড় করার জন্য ২০২২ সালে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা পিকেএসএফ ও ইফাদের আর্থিক সহযোগিতায় ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (এনডিপি) রুরাল মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট থেকে ঋণ নেন।
তাপসী জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গরু পালনের ওপর তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ থেকে পাওয়া জ্ঞান প্রয়োগ করেছেন খামারে। এতে সফলতাও পেয়েছেন তিনি।
তাপসী বলেন, "এরমধ্যে ১৬ শতক জমিতে ঘাষ চাষ করেছি। উৎপাদিত ঘাস থেকে সাইলেজ তৈরি করে প্রাণিকে খাওয়াচ্ছি। খামারে এখন দুটি গাভীসহ আরও কয়েকটি গরু রয়েছে। প্রতিদিন ১০ লিটার দুধ পাই। গোয়ালার কাছে তা ন্যায্যমূল্যে চুক্তিভিত্তিকভাবে বিক্রি করি। এতে বেশ ভালোই চলছে সংসার।"
উল্লাপাড়া উপজেলার সলপ গ্রামের বাসিন্দা মীরা সান্ন্যাল (৫০)। পরিবারে বৃদ্ধ মা ও ভাইয়ের সংসারে থাকেন। ৩৫ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু যৌতুকের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় স্বামীর বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় তার। শুরু হয় জীবনযুদ্ধ। এখন তার খামারের একটি গাভী থেকে দিনে ১২ কেজি দুধ হয়।
মীরা সান্ন্যাল জানান, "প্রশিক্ষণে শিখেছি কীভাবে কম খরচে পশু লালন-পালন করা যায়। দুধ ব্যবসায়ীদের সাথেও পরিচয় হয়েছে। তাদের মাধ্যমে এখন প্রতিদিন মাসিক চুক্তি ভিত্তিতে দুধ বিক্রি করি। এতে দামের বেলায় ঠকতে হয় না। ভোগান্তিও কম হয়।"
খামারিরা বলছেন, সুস্থ্য পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষেয় তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। বায়োগ্যাস, ভার্মি কম্পোস্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছেন অনেকেই। অনেকে যান্ত্রিকীকরণের লক্ষ্যে ঘাস কাটার মেশিন কিনেছেন। মোবাইলে অ্যাপ ব্যবহার করে টেলিমেডিসিন সেবা নিচ্ছেন।
নিরাপদ ও আধুনিক উপায়ে গরু লালন-পালনে এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি)।
এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন খান জানান, "সিরাজগঞ্জ ও পাবনার প্রচুর পরিমাণ দুধ উৎপাদিত হয়। এই এলাকার খামারিদের আধুনিক ও নিরাপদ পদ্ধতিতে দুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের সঠিক পথ দেখানো গেলো দেশ উপকৃত হবে। দেশের মানুষও নিরাপদ পণ্য খেতে পারবে। তৈরি হবে নতুন নতুন উদ্যোক্তাও।"
এ সম্পর্কে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. ওমর ফারুক বলেন, "সিরাজগঞ্জ আসলে বর্তমানে দুগ্ধ শিল্প অঞ্চল হিসেবে পরিচিত হয়েছে। এরমধ্যে জেলার উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলা দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। দুই উপজেলায় ৩৭টি ডেইরি কারখানা আছে। এখানে দই, মিষ্টি, ঘোল, মাঠাসহ হরেক রকমের পণ্য তৈরি হয়। জেলার চাহিদা মিটিয়ে বাইরের জেলাতেও যায় এসব পণ্য।"