ভারতীয় গম আমদানির বাধা কঠিন সব শর্ত
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গম রপ্তানি বন্ধ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। কিন্তু রপ্তানিকারকদের নানা শর্ত ও জিটুজি (সরকার-টু-সরকার) পদ্ধতির বাইরে না যাওয়ার ঘোষণায় গম না পাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে
বাংলাদেশের আমদানিকারকরা বলছেন, জিটুজি পদ্ধতিতে গম আমদানিতে বেশ বেগ পোহাতে হবে ব্যবসায়ীদের।
তাছাড়া রপ্তানিকারকের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়ার পাশাপাশি ওই রপ্তানি কোটার লিমিটেশনও বেঁধে দিয়েছে ভারত। এ কারণে ট্রেডার খুঁজে পাবেন না বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। আবার বাংলাদেশের চাহিদার ভিত্তিতে ভারত সরকারের অনুমোদনের পর তা টেন্ডারের মাধ্যমে আমদানি বেশ সময়সাপেক্ষ বলেও মন্তব্য করছেন তারা।
রপ্তানি কোটার উপর সীমাবদ্ধতা বসিয়ে দেওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠবে। ভারতীয় গমের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ গম রপ্তানিতে ইচ্ছুক ট্রেডার খুঁজে পেতে হিমশিম খাবে।
বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারের প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (অপারেশন্স) তারিক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা আন্তর্জাতিক ট্রেডারদের কাছ থেকে গম কিনি। ওরাই ভারতীয় বাজার থেকে গম নিয়ে আমাদের সাপ্লাই দেয়। এখন রপ্তানিকারকদের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার শর্তের কারণে নতুন ট্রেডার পাওয়া কঠিন হবে।
গম আনার জন্য অংশ নিতে হবে সরকারি টেন্ডারে। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া।'
টেন্ডারে পাওয়া গম আবার সরকারকে দিতে হবে বলে জানান তিনি।
তারিক বলেন, 'আমাদের খাদ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ডিমান্ড লেটার পাঠানোর পর অনুমোদনসাপেক্ষে আমদানিকারকেরা সরকারি টেন্ডারে অংশ নেবে। টেন্ডারে পাওয়া গম আমদানির পর তা আবার সরকারকে দিতে হবে। এরপর সরকার সেই গম আমাদের দেয় কি না, সেটি এখনও জানি না। ফলে ভারতের গম নিয়ে আমরা এখনো নিশ্চিত নই,' যোগ করেন তারিক আহমেদ।
এছাড়া আগে অর্ডার করা গমের সরবরাহই পাবেন কি না, তা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন বলে জানান তারিক।
তীব্র দাবদাহের কারণে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী ভারতে এবার শস্যটির উৎপাদন কম হয়েছে। সে কারণে ভারতের স্থানীয় বাজারেও গমের দাম রেকর্ড সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এই পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে গত ১৩ মে গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ববাজারে গমের দাম বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর খাদ্যশস্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এ সময় বিশ্বের বৃহত্তম গম সরবরাহকারী হয়ে উঠেছিল ভারত। তাই ভারতের গম রপ্তানি বন্ধের খবরে বাংলাদেশের গমের বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছে।
খাদ্যপণ্যে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে ভারতের এই গম রপ্তানি নিষিদ্ধের খবরে ভোক্তাদের খরচ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তবে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাস। পাশাপাশি আগের চুক্তিভুক্ত গমের প্রাপ্তি নিয়ে সমস্যা হবে না বলেও জানিয়েছে তারা।
তবে নতুন করে চুক্তি করা এবং ভারত সরকারের সঙ্গে দরকষাকষি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার বলে মনে করছেন তারিক আহমেদ।
তিনি বলেন, 'আমরা এখনও সব শর্ত জানি না। আমাদের সরকারের উচিত হবে শিগগিরই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা। শর্তগুলো যতদূর সম্ভব কমিয়ে এনে বেসরকারি খাতের জন্য গম আমদানি উন্মুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন।'
ভারত বৈশ্বিক সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশে ৬.৫৯ মিলিয়ন টন গম রপ্তানি করে। বাংলাদেশ একাই এই রপ্তানির ৫৩ শতাংশ বা ৩.৪৯ মিলিয়ন টন আমদানি করেছে। অর্থাৎ ভারতের গমের ওপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশ।
ভারত থেকে আমদানি নিশ্চিত না হলে তা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভোগাবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারারা।
তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের গম বন্ধ হওয়ার পর স্বল্পমূল্যের গমের জন্য ভারতই বাংলাদেশের ভরসা। কারণ কানাডা, আমেরিকা ও ইইউ থেকে আমদানি করা গম সাধারণত চানাচুর, পাস্তা, বার্গার, পিৎজা, কেকসহ হাই-ভ্যালু খাদ্যপণ্যে ব্যবহার হয়।
বাংলাদেশ অটো বিস্কিটস অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি মো. শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, 'ভারতের গমে রুটি-পরোটা, পাউরুটি, সাধারণ বিস্কুটসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন হয়। ফলে হয়তো অনেক নিম্ন-আয়ের মানুষ, যারা কোনো এক বেলা হয়তো একটা-দুইটা রুটি পরোটা, চায়ের সঙ্গে পাউরুটি ভিজিয়ে খেয়ে পার করে দিচ্ছে, তাদের খরচটাও বেড়ে যাবে। আমেরিকা, কানাডার গমে এ শ্রেণির মানুষের প্রয়োজনীয় গমের সোর্সিংটা হবে না।'
যদিও ভারত থেকে গম আমদানিতে অসুবিধা হবে না বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
বুধবার (১৮ মে) সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে তিনি বলেন, 'আমি [ভারতের] হাইকমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। উনিও একটা প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন যে, জিটুজি বন্ধ করা হয়নি, সরকারি লেভেলে যত খুশি আনা যাবে।
'এমনকি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যারা বড় বড় আমদানিকারক আছেন, চাইলে চিঠি দিয়ে পারমিশান করে নিতে পারবেন। পুরোপুরি ১০০ ভাগ আমদানিতে কোনো বাধা নেই৷ এজন্য ভারতের নিষেধাজ্ঞা আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে না।'
দুই মাসে দ্বিগুণ হয়েছে ভারতীয় গমের দাম
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশ দুটি থেকে গমের সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। তাই বিশ্ববাজারে দেখা দিয়েছে সংকট। এর জেরে গত ২৫ মার্চের পর থেকে গত দুই মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ভারতীয় গমের দাম।
দেশের বাজারে আমদানির পর পাইকারি পর্যায়ে গত মার্চে মণপ্রতি ৯০০ টাকায় বিক্রি হওয়া গম এখন বিক্রি হচ্ছে ১,৬০০ টাকায়।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় নতুন গম এলেও দাম আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তার।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডস্ট্রিজ-এর সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, '২০০ ডলারের টন থেকে এখন ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে ভারতীয় গমের দাম। সরকারি জিটুজি পদ্ধতিতে নানা ধাপ পেরিয়ে গম আমদানি করতে পারলেও এর দাম কী পরিমাণ বাড়বে, তা আমরা নিশ্চিত নই।'
খাদ্য সচিব মোসাম্মত নাজমুনারা খানম বলেন, 'আমরা সাধারণ সময়েও আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ভারতের থেকে কম দামে গম পেতাম। রাশিয়া-ইউক্রেনের গম আসা বন্ধ হওয়ার পর আমরা ভারত থেকে আনার চেষ্টা করেছি।
'আমাদের সঙ্গে ভারতের কমিটমেন্টও রয়েছে। আশা করছি ভারত থেকে গম পাব। তবে বৈশ্বিক সংকটের কারণেই দাম বেশি দিতে হবে।'