নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচার শিল্পে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা, অভাব তদারকির
১৯৯৮ সালে মাত্র ৫ লাখ টাকা ও ৫ জন কাঠমিস্ত্রি নিয়ে ফেনীর ছাগলনাইয়া বাসস্ট্যান্ড বাজারে ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন জি এস ফার্নিচার মার্টের মালিক মোঃ শহিদ উল্লাহ। বর্তমানে তার কারখানায় ২৫ জন লোকের কর্মসংস্থান, তার বার্ষিক টার্নওভার ৩ কোটি টাকার বেশি।
শহিদ উল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আশেপাশে মানুষের কাঠের ফার্নিচারের চাহিদা দেখে আমি ২৪ বছর আগে এ পেশায় আসি, তারপর থেকে ভালোই সাড়া পাই। আস্তে আস্তে আমার ব্যবসার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে প্রতি মাসে আমার ১২-১৫ লাখ টাকার ফার্নিচার বিক্রি হয়, আশা করি আমার ব্যবসা আরো বিস্তৃতি লাভ করবে।"
শহিদ উল্লাহ মতো আরেকজন শেরপুর জেলার সদর উপজেলার পশ্চিমশেরী এলাকার ফার্নিচার মার্টের স্বত্মাধিকারী আবদুর রহমান। একসময় কাঠমিস্ত্রি ছিলেন তিনি, কয়েক বছর পরে তিনি শেরপুরের পশ্চিমশেরী এলাকায় নিজেই কারখানা ও দোকান দেন। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পুঁজি। এখন এ তার বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ২ কোটি টাকা।
"আমার কারখানার আসবাব শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। এই ব্যবসা আমার জীবন বদলে দিয়েছে। এ ব্যবসার আয় দিয়ে গ্রামে জমি কিনেছি, দোতলা বাড়ি করেছি শহরে।"
শহিদ উল্লাহ আর আবদুর রহমানই নয়, নন-ব্র্যান্ড কাঠের ফার্নিচার শিল্প এভাবে আরও অনেক মানুষেরই জীবন বদলে দিয়েছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃ্দ্ধি পাওয়ায় এখন ফার্নিচারের চাহিদাও বেড়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন সরকারি নীতির সহায়তা পেলে ব্র্যান্ডেড ফার্নিচার কোম্পানির সাথে সাথে এই শিল্পও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়ক হতে পারে, কারণ বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, দেশের প্রায় ৯৫% নন-ব্র্যান্ড আসবাবপত্র এসব ক্ষুদ্র কারখানায় তৈরি নির্মিত হয়। তাদের বাদ দিয়ে ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় হাজার। এর বাইরে সারাদেশে প্রায় ৬৫০০টি এসব নন ব্র্যান্ড ফার্নিচার কারখানা গড়ে উঠেছে।
এরমধ্যে চট্টগ্রামের মীরসরাই বলিরহাটের বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজারেরও অধিক, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার ছালাভরা গ্রামে প্রায় ২০০, পঞ্চগড় সদরে প্রায় ১৫০, শেরপুর সদর উপজেলায় গড়ে উঠেছে ৩০০, পিরোজপুরে ৪০০, টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ধলাপাড়া ১০০, বগুড়ার নন্দীগ্রামে প্রায় ৩০০টির মতো ছোট-বড় রেডিমেড ফার্নিচার কারখানা। লক্ষীপুরে ২০০ টি কারখানা, ফেনীতে ১৫০ টি কারখানা গড়ে উঠেছে।
এছড়াও কুষ্টিয়ার শহরের গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০০ টি কারখানা, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে ১০০টি, এবং চট্টগ্রামের উখিয়ার হলদিয়া-পার্বতীপুরে প্রায় শতাধিক কারখানা ঘরে উঠেছে।
আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা সংস্থা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে ফার্নিচারের বিশ্ববাজারের আকার ৫৬০ বিলিয়ন ডলার।
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, কম করে হলেও বার্ষিক ২৫ হাজার কোটি টাকার বাজার দেশের ফার্নিচার খাতের, এরমধ্যে নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচারের বাজারের বাজার ৫০ শতাংশের বেশি।
৪ লাখের বেশি মানুষ এ খাতে কর্মসংস্থানে নিয়োজিত। এ খাতে সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি ঘটেছে ৯০ এর দশকের পর থেকে।
তবে ব্র্যান্ড ফার্নিচারের উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশে এখন আসবাবপত্রের বাজার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো। এই খাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩০ শতাংশ। গত ১০ বছরে ফার্নিচারের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ।
তারা বলছেন, কাঠের পরিবেশবান্ধব ফার্নিচারের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেশিরভাগ ক্রেতা রেডিমেইড ফার্নিচারের দিকে ঝুঁকছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশীয় কাঠের, সরকারি অকশনের কাঠ ছাড়াও নেপাল, ভারত, মালয়েশিয়া, আফ্রিকা থেকেও কাঠ আমদানি করে থাকেন কিছু কিছু নন-ব্র্যান্ড উদ্যোক্তারা।
তারা জানান, এসব কারখানার মালিকরা প্রায় সবাই কারিগর থেকে বর্তমানে মালিক হয়েছেন, ফলে তারা নিজেরাই কারখানার নতুন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এভাবেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিকরা কয়েক বছরে দক্ষ কারিগর হয়ে হয়ে গড়েন।
সাধারণত কারখানা মালিকদের অনেকের নিজস্ব দোকান বা শো-রুম আছে। তারা সেসব শো-রুম, দোকানে নিজস্ব তৈরি পণ্য বিক্রয় করে থাকে। উদ্যোক্তাগণ ক্রেতার কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে কিছু পণ্য সরাসরি ক্রয় করে থাকে।
রফিকুল ইসলাম দীর্ঘ ৮ বছর ধরে এ শিল্পে ফার্নিচার মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, আমার দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় হয়, কোনো দিন যদি কাজের চাপে রাতে ওভার টাইম কাজ করি তাহলে ওইসব দিনে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় হয়।
তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন- এলাকার অনেক শ্রমিক-কারিগর প্রবাসে উচ্চ বেতনে চলে যাওয়ায় দিন দিন দক্ষ মিস্ত্রি-কারিগরের সংকট তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে ফার্নিচার ফেনীর ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, "এখান থেকে ফার্নিচার বানানোর কাজ শিখে মিস্ত্রিদের অনেকে মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়ায় চলে গেছে। ফলে আমরা এখানে মিস্ত্রি সংকটে পরেছি, আর নতুন করে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না খুবই কম, যারা আসে তারা তো ৪-৫ বছর কাজ শেখার আগে দক্ষ মিস্ত্রি হতে পারে না।"
লক্ষীপুর জেলার শাহীন ফার্নিচারের স্বত্বাধিকারী তোফায়েল আহমেদ বলেন, "সরকারের উচিত এখানকার শ্রমিক ঘাটতি পূরণের জন্য বেশি সংখ্যাক শ্রমিককে এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কারিগর বানানো,উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক লোক দেওয়া। উন্নত মেশিনারি প্রযুক্তি, জিজাইন ইত্যাদি সহযোগিতা দিলে এ শিল্পের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এক সময় বিদেশেও ফার্নিচার রপ্তানি করতে পারবে।"
স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে ফার্নিচার রপ্তানির পরিসংখ্যান নতুন সম্ভাবনার বার্তা দিচ্ছে। এ শিল্প থেকে চীন ধীরে ধীরে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। বিশ্ববাজারে ফার্নিচারের সিংহভাগ সরবরাহকারী চীন গুটিয়ে নিচ্ছে তাদের ব্যবসা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্র্যান্ডেড এবং নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচার আরএমজির মতো আমাদের শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হতে পারে যদি আমরা এই খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি।
এসএমই'র এই ক্ষুদ্র নন-ব্র্যান্ড ফার্নিচার শিল্প নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গ্যানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ (ওএসএল) বিভাগের অধ্যাপক ড শরিয়ত উল্লাহ।
তিনি বলেন, "দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ ফার্নিচার কারখানাই মাইক্রো লেভেলের । তাই এসব কারখানা তেমন মালিক সমিতি-সংগঠন নেই, যার ফলে পরিসংখ্যান না থাকায় এসব কারখানায় সরকারি-বেসরকারি তেমন সাপোর্ট পৌছায় না। তবে এই পরিবেশবান্ধব খাতটি খুবই সম্ভাবনাময়।"
তিনি আর বলেন, "সরকারি সুনজরের পাশাপাশি যদি বড় ব্র্যান্ড ফার্নিচার প্রতিষ্ঠানগুলো নন-ব্র্যান্ড (মাঝারি, ছোট, ক্ষুদ্র) কারখানাগুলোকে কন্ট্রাক্ট ম্যানুফেকচারিংয়ের আওতায় নিয়ে আসে তাহলে ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর যেমন রপ্তানি বাড়বে,তেমনি নন-ব্র্যান্ড কারখানারও বিস্তৃতি বাড়বে, এ খাত আরও তখন দুই-তিনগুন বড় হবে।"
এ ব্যাপারে এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ মুফিজুর রহমান বলেন, "বর্তমানে দেশ-বিদেশে মানুষ পরিবেশবান্ধব পন্যের দিকে ঝুঁকছে, সেই হিসেবে প্লাস্টিকের চেয়েও কাঠের ফার্নিচার পরিবেশ সম্মত হওয়ায় আগামীতেও এর চাহিদা বাড়বে।"
"ইতোমধ্যে সারাদেশে এসব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠা বেশ কিছু ক্লাস্টারে আমরা সম্ভাব্যতা যাচাই গবেষণা করেছি। সামনে কারিগর শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।"
ব্যাংকগুলোকে উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন তিনি।