পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দিলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন: এফবিসিসিআই
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থপাচারকারীদের অপ্রকাশিত অফশোর সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। সংস্থাটির মতে, এ উদ্যোগ মূলত সৎ করদাতাদের কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করবে।
শনিবার (১১ জুন) ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, "এই সুবিধা মানুষকে কেবল বিদেশে অর্থ পাচার করতেই উৎসাহিত করবে।"
"দেশের অভ্যন্তরে, একজনকে ২২ থেকে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। সেখানে বিদেশে পাচার করা অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়েই দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে। তাহলে তো টাকা বিদেশে নিয়ে গেলেই লাভ", যোগ করেন তিনি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশের শীর্ষ এই বাণিজ্য সংস্থা।
বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে। এছাড়া বিদেশে থাকা ইমুভেবল (স্থির সম্পদ) ও মুভেবল অ্যাসেট ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে বৈধ করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এই সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব আসার পর থেকেই সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। যদিও শুক্রবার এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল ইন্দোনেশিয়াসহ আরও বেশকিছু দেশ এ প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন।
তবে শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, সরকার কী কারণে এ সুযোগ দিয়েছে জানি না, তবে এতে সৎ ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
সংবাদ সম্মেলনে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানায় ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ সংগঠন। একই সঙ্গে বেশকিছু উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের অস্বস্তি ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিশেষত রপ্তানির সোর্স ট্যাক্স দ্বিগুণ করা, অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) ও অ্যাডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়া, ল্যাপটপসহ কিছু পণ্যের আমদানিতে ভ্যাট ও কাস্টমস ডিউটি আরোপ করা, ব্যাংক ইন্টারেস্টের ওপর সোর্স ট্যাক্স দ্বিগুণ করা, ট্যাক্স অফিসিয়ালদের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বাড়ানোসহ কয়েকটি বিষয়ে নিজেদের অস্বস্তি তুলে ধরা হয় এফবিসিসিআই'র পক্ষ থেকে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, আমাদের প্রস্তাব নেওয়া হলে, বাজেট আরও ব্যবসাবান্ধব হবে।
কোম্পানির জন্য কিছু শর্তে কর্পোরেট করহারে ছাড় দেওয়া হলেও এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে না জানিয়ে এফবিসিসিআই'র পক্ষ থেকে বলা হয়, কর্পোরেট করহারে ছাড় দেওয়া হলেও এআইটি ও এটি'র মাধ্যমে তা আবার নিয়ে নেওয়া হবে। এতে ছাড়ের চেয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বেশি। এ কারণে কর্পোরেট কর ছাড়ের সুবিধা করদাতাদের জন্য বিশেষ কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলে জানায় সংস্থাটি।
ব্যক্তি করদাতাদের ট্যাক্স ফ্রি ইনকাম লিমিট না বাড়ানোয় হতাশা প্রকাশ করে এফবিসিসিআই'র পক্ষ থেকে তা বিদ্যমান ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখ টাকা করার আহ্বান জানানো হয়।
ল্যাপটপের আমদানিতে ভ্যাট আরোপের বিরোধিতা করে এফবিসিসিআিই'র পক্ষ থেকে বলা হয়, "দেশে ভালো মানের ল্যাপটপ উৎপাদন হলে আমরাই স্থানীয় শিল্পের সংরক্ষের স্বার্থে আমদানিতে বাড়তি কর আরোপের প্রস্তাব দিতাম। আমরা তো এমন প্রস্তাব দেইনি। তাহলে কে চেয়েছে?"
একইভাবে কোভিড সুরক্ষা সরঞ্জামের ওপর কর আরোপ নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করে ব্যবসায়ীদের এ র্শীষ গঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, "কোভিড এখনো যায়নি। এখনই এর ওপর কর আরোপ করা হয়েছে, এটি কি ঠিক হলো?"
ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ইন্টারেস্টে সোর্স ট্যাক্স দ্বিগুণ করায় মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে উল্লেখ করে জসিম উদ্দিন বলেন, "১০০ টাকায় ২০ টাকাই যদি সরকার নিয়ে নেয়, তাহলে থাকে কী? মানুষতো আর ব্যাংকে টাকা রাখবে না। বালিশের নিচে রাখবে। আমরা তো এমন কোনো প্রস্তাব দেইনি।
অন্যদিকে, এনবিআর কর্তৃক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইলেক্ট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন তদারকির দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষকে দেওয়া এবং এর বিনিময়ে কর আয়ের ১ শতাংশ ওই প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার বিরোধিতা করা হয় এফবিসিসিআই'র পক্ষ থেকে। এর স্থলে বরং যেসব প্রতিষ্ঠান ইএফডি ব্যবহার করবে, তাদের ওই ১ শতাংশ কর ছাড় দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
এছাড়া বাজেট ঘাটতি মেটাতে স্থানীয় ব্যাংক ব্যবস্থার পরিবর্তে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থায়নের আহ্বান জানিয়ে এফবিসিসিআই'র পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যাংক ঋণের (সরকারের জন্য) ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরতা বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানোয় ব্যবসায়ীদের হয়রানি বাড়বে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রিজওয়ান রহমান। তিনি বলেন, "কর্মকর্তাদের ৫০ লাখ টাকা জরিমানার ক্ষমতা দিলে হয়রানি ও স্বেচ্ছাচারিতা বাড়বে। এর চেয়ে বরং মামলা করুন, আইনের আওতায় আনুন। আইন যদি মনে করে, তাহলে প্রয়োজনে জেলে যাবে।"
সংবাদ সম্মেলনে ট্যাক্স ব্যবস্থা সহজ ও ব্যবসাবান্ধব করা, পাইকারি পর্যায়ে ভ্যাট হার ০.৫ শতাংশ করা এবং তা অল্প কিছু পণ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা, আপিলের ক্ষেত্রে ডিসপুটেড অ্যামাউন্টে ২০ শতাংশ জমা দেওয়ার শর্ত শিথিল করার দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি সাইফুল ইসলাম, এফবিসিসিআই সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহ-সভাপতি ফজলুল হক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সোর্স ট্যাক্স দ্বিগুণ হলে ধাক্কা খাবে রপ্তানি
রপ্তানির সোর্স ট্যাক্স বিদ্যমান ০.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করায় রপ্তানি আয় ধাক্কা খাবে বলে মনে করছে এফবিসিসিআই।
এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, সারা পৃথিবীতে মন্দা চলছে। এই সময়ে রপ্তানির ট্যাক্স কোনোভাবেই শতভাগ বাড়ানো যৌক্তিক নয়।
"যে ০.৫ শতাংশ নেওয়া হয়, তা মূলত এফওবি (ফ্রেইট অন বোর্ড বা রপ্তান মূল্য) ভ্যালুর ওপর। প্রকৃত আয়ের ওপর এই করহার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। এই দ্বিগুণ করের কারণে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাবে রপ্তানি খাত। অথচ এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা দরকার," যোগ করেন তিনি।