‘উৎসে কর দ্বিগুণ হওয়ায় করপোরেট কর কমানোর সুবিধা পাওয়া যাবে না’
প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের মতো সব রপ্তানিকারকদের করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে তৈরী পোশাক খাতের মতো সুবিধা দিয়েছে সরকার। তবে রপ্তানির উৎসে কর দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ীরা।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের বাজেটোত্তর আলোচনা 'ফিসক্যাল ইনসেনটিভস ফর নন-অ্যাপারেল এক্সপোর্টারস: হাউ মাচ ইন ডিড' শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব মন্তব্য করেন তারা। ২০ বছর আগে আরএমজিকে দেওয়া সুবিধা এখন অন্যান্য রপ্তানিকারকদের দিলে লেদার গুডস, জুট ও জুট গুডস, এগ্রিকালচার, ফ্রোজেন ফুড, ফার্মাসিউটিক্যালস, আইসিটি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্লাস্টিকের মতো খাতও মডেল হবে জানিয়েছেন তারা।
টিবিএসের চিফ রিপোর্টার মোরশেদ নোমানের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরএন পাল এবং এপেক্স ফুটওয়্যারের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর দিলীপ কাজুরি।
করপোরেট করে ছাড় দেয়ার সুবিধা এই মূর্হতে কাজে আসবে না জানিয়ে রিজওয়ান রহমান বলেন, 'নন আরএমজির জন্য করপোরেট ট্যাক্স কমানোতে দীর্ঘমেয়াদে হয়তো কিছু বেনেফিট আছে। তবে উৎসে কর কেটে তা আবার সমন্বয় না করার কারণে অন্য খাতের কোম্পানিগুলো বেনেফিটেড হবে না।'
তিনি বলেন, 'সবার জন্য সমান সুবিধা মানে শুধু করপোরেট ট্যাক্স নয়। বন্ড সুবিধা, ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধাসহ নানা ক্ষেত্রে ইক্যুয়ালের বিষয় রয়েছে। আরএমজি তিন বছরের জন্য বন্ড সুবিধা পায় আর ট্যানারি পায় এক বছরের জন্য। অন্য অনেক খাত তা পায়ই না। আরএমজি ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা পায়, অন্যরা পায় না। উপকরণ সংগ্রহে এটিভি, ভ্যাটসহ নানা ক্ষেত্রে ছাড় পায় আরএমজি। এটিও অন্যদের নেই।'
নন-আরএমজি সেক্টরকে দীর্ঘমেয়াদে সুবিধা দেয়া দরকার জানিয়ে রিজওয়ান রহমান বলেন, 'করছাড়, আর্থিক প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ফিসক্যাল সুবিধা আরএমজি শুরু থেকেই পেয়ে আসছে। দীর্ঘদিনের সুবিধা নিয়ে খাতটি এখন সারাবিশ্বে মেড ইন বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে।'
আরএমজির মতো আরেকটা 'সাকসেস স্টোরি' করতে গেলে সেখানেও এমন সুবিধা দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আরএমজিকে ৪০ বছর ধরে নার্সিং করে আমরা এখন এখান থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ধরছি। ফুটওয়্যার, জুট, এগ্রিকালচার ও আইসিটির মতো সেক্টরকে আমরা এমন পরিচর্যা করলে তারাও ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলার করে এনে দিতে পারবে।'
দেশের শীর্ষ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের এমডি আরএন পাল বলেন, 'গার্মেন্টসের বাইরে অন্য প্রডাক্ট যে রপ্তানি বাজারে ভালো করতে পারে তার উদাহরণ প্রাণ-আরএফএল। বাইসাইকেল, ফার্নিচার, খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে আমরা ভালো করছি। তবে সমস্যা হলো উৎসে কর। কাঁচামাল আমদানির সময়ই উৎসে করে কেটে রাখায় বিপুল পরিমাণ ক্যাপিটাল আটকে যায়। এতে ব্যবসা করা কঠিন।'
তিনি বলেন, 'পণ্য রপ্তানির সময়ও ১ শতাংশ হারে উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে। এক্সপোর্টার লোকসান করলেও এ আর ফিরিয়ে দেবে না এনবিআর। ফলে করপোরেট করে যে ছাড় দিয়েছে তা এক্সপোর্টারদের জন্য কাজে আসবে না।'
'এক্সপোর্ট ডাইভারসিফাই করার জন্য নতুন সেক্টরগুলোর এটিভি, সোর্স ট্যাক্সসহ বিভিন্ন করে ছাড় দিতে হবে। কারণ এসব ট্যাক্স ব্যবসার আগেই দিয়ে দিতে হয়। টাকা আটকে যাওয়ার কারণে ব্যবসা করা সম্ভব হয় না। প্রথমে ব্যবসার সুযোগ দিয়ে পরে করপোরেট ট্যাক্স কমালেই তা নতুন সেক্টর বিকাশে ভূমিকা রাখবে', যোগ করেন তিনি।
ট্যানারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান করপোরেট কর ছাড়ের সুবিধা পাবে না বলে মন্তব্য করেছেন দিলীপ কাজুরি।
তিনি বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে সুবিধা পেয়ে একটা অবস্থানে যাওয়ায় আরএমজি এখন করপোরেট কর দিচ্ছে। তারা ২০১৯ পর্যন্ত ০.২৫ শতাংশ হারে উৎসে কর দিয়েছে। তখন এই করকে কোম্পানির চূড়ান্ত কর হিসাবেও গণ্য করেছে। কিন্তু আমাদের জন্য এখন উৎসে করহার ১ শতাংশ। এটা এক্সপোর্ট বিলের ওপর কাটা হয়। এটিকে আবার চূড়ান্ত কর হিসাবেও গ্রহণ করা হয় না।'
তিনি বলেন, 'বর্তমানে ০.৫০ শতাংশ উৎসে কর দিতেই আমাদের মোট মুনাফার ৭০ শতাংশের সমান অর্থ চলে যায়। এই উৎসে কর ১ শতাংশ পরিশোধ করলে আমাদের মুনাফাই থাকবে না। ফলে করপোরেট করে ছাড় দেওয়া-না দেওয়া আমাদের জন্য কোনো খবর নয়। ফুটওয়্যার খাতের কোনো কারখানাই এর দ্বারা উপকৃত হবে না।'
'আরএমজি সেক্টরকে রপ্তানির জন্য বাইরে গিয়ে মার্কেটিং করতে হয় না। বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের বায়িং হাউজের মাধ্যমে দেশ থেকে পোশাক কিনে। কিন্তু অন্য সেক্টরগুলোকে ক্রেতা খুঁজতে হয়। তাদের মোট রপ্তানির ৫-৭ শতাংশ মার্কেটিং কমিশনে ব্যয় করতে হয়। কিন্তু এর ওপর আবার ২০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়,' যোগ করেন দিলীপ কাজুরি।
রপ্তানি বহুমুখীকরণে এ মুহূর্তে গার্মেন্টস ছাড়া আর কোন সেক্টরে ফোকাস করা যায় এমন প্রশ্নে রিজওয়ান রহমান বলেন, '২০২০ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মনিটরিং অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি অব এক্সপোর্ট ডাইভারসিফিকেশন করা হয়। তখন থেকেই আমরা লেদার গুডস, জুট, এগ্রিকালচার, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, আইসিটি, ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক খাতকে বাছাই করে এর সম্ভাবনা তুলে ধরি।'
'২০২৫ সালে আইসিটি থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ খাতে আমাদের বহু উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। কৃষি খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে মেশিনারি সহজলভ্য করতে হবে। ক্যাপিটাল মেশিনারিতে ইনসেনটিভস দিতে হবে। ওয়্যারহাউজ করে দিতে হবে', যোগ করেন তিনি।
এদিকে এই মূর্হতে নন-আরএমজি খাতকে কী সুবিধা দিতে হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে আরএন পাল বলেন, '২০ বছর আগে আরএমজিকে যে সুবিধা দেয়া হয়েছে অন্যান্য খাতে এখন তা দিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'সেক্টরগুলোকে চিহিৃত করে ইনসেনটিভ দিতে হবে। আমরা এখন কোথাও ক্যাশ ইনসেনটিভ পাচ্ছি, কিন্তু বন্ড পাচ্ছি না। আবার বন্ড পেলেও নানা সীমাবদ্ধতা থাকছে। আমাদের মূল দাবি হলো- শুধু একটি কর নয়, সব ক্ষেত্রেই আরএমজির মতো সুবিধা দিতে হবে।'
লেদার সেক্টর প্রসঙ্গে কাজুরি বলেন, 'লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, করপোরেট ট্যাক্স আরএমজিতে আগে যা দেয়া হয়েছে অর্থাৎ ০.২৫ শতাংশ করে দিতে হবে।'
রিজওয়ান রহমান বলেন, '২০৩০ এর পর আমাদের ট্রিপস (ট্রেড-রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) সুবিধা থাকবে না। তখন আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালস মেধাস্বত্ত্ব আইনে আটকে যাবে। এজন্য এপিআই দ্রুত শেষ করতে হবে। ট্যানারির জন্য লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে আলাদা আলাদা সেক্টরকে তাদের সমস্যাগুলো চিহিৃত করে সুবিধা দিতে হবে।'
কোনো খাতকে সুবিধা দেয়ার আগেই তার ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ তৈরি করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন আলোচকেরা।
রিজওয়ান রহমান বলেন, 'আমাদের স্থানীয় বাজার বা রপ্তানি বাজার যেখানেই সফল হতে চান তার জন্য ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ লাগবে। কাঁচামাল সংগ্রহের সহজ পথ পেলে ইন্ডাস্ট্রি তাদের অপারেশন সুষ্ঠুভাবে করতে পারবে। পণ্য উৎপাদন করে তা রপ্তানি করতে পারবে।'