অজ্ঞাত মালিকের এই ফটো স্টুডিও যেন কয়েক দশকের আফগান ইতিহাসের সাক্ষী!
গত মাসে আফগানিস্তানের ছবি তোলার স্টুডিয়োগুলোতে শত শত মানুষের ঢল নেমেছিল। পাসপোর্ট ও আইডি কার্ডের জন্য ছবি তুলতে এভাবে স্টুডিয়োতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন তারা।
আফগানিস্তান এখন তালেবানের দখলে। আমেরিকানরা চলে গেছে—হাজার হাজার আফগানও দেশটি ছাড়ার চেষ্টা করছে। দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ যেহেতু কমে আসছিল, সেজন্য ভিসা আবেদন করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল বহু আফগান।
যেসব আফগান দেশ ছাড়ার সুযোগ পেয়েছেন, তারা খুব কম জিনিসই সঙ্গে নিতে পেরেছেন। কেউ কেউ পরিবারের ছবি নিয়েছেন সঙ্গে, কেউ নিয়েছেন দুই দশকের সঙ্ঘাতে প্রাণ হারানো প্রিয়জনের ছবি।
কাবুলের এক স্টুডিয়ো খোলা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। যে ব্যক্তি খুলেছিলেন, তার ছেলে এখন এই স্টুডিয়ো চালান। স্টুডিয়োতে ঢুকতেই এর প্রতিষ্ঠাতার একটা ছবি দেখা যায়—বক্স ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আফগানিস্তানে বহু দশক ধরে বক্স ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দেশটিতে বক্স ক্যামেরা পরিচিত কামরা-ই-ফাওরি নামে, যার অর্থ 'তাৎক্ষনিক ক্যামেরা'। এই অনন্য ক্যামেরাটি হাতে তৈরি। এর লেন্স শাটারবিহীন। এতে ছবি তোলা হয় অ্যানালগ পদ্ধতিতে, শুধু প্রাকৃতিক আলো ব্যবহার করে। ডার্করুমে ছবি ওয়াশ করা হয়।
সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই স্টুডিয়োর প্রতিষ্ঠাতা শুনিয়েছেন পুরনো দিনের গল্প। আফগানিস্তানের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। দেশটির শেষ রাজা জহির শাহের শাসনামল প্রত্যক্ষ করেছেন এই ব্যক্তি; দেখেছেন সোভিয়েত আক্রমণ, তালেবানের উত্থান, মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলা এবং ফের তালেবানের উত্থান।
এনপিআরকে তিনি বলেন, 'তখন ছিল শান্তির সময়। আমাদের তেমন কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। আমি ঘরে ঘরে গিয়ে আফগানদের ছবি তুলে দিতাম। এন্তার গ্রাহক ছিল আমার। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেকেই ভয় পেয়ে গেল। স্টুডিয়োতে আসা বন্ধ করে দিল তারা। তারপর মার্কিনরা আফগানিস্তানে আসার পর আমার গ্রাহকরা ফের ছবি তুলতে আসতে লাগল। কিছু কিছু বিদেশিও আমাকে ডেকে নিয়ে ছবি তুলিয়ে রাখত।'
১৯৯০-এর দশকে ক্ষমতায় আসার পর ইসলামবিরোধী আখ্যা ছবি তোলা নিষেধ করেছিল তালেবান। কোথাও ছবি টাঙিয়ে রাখা কিংবা কোনো জীবিত প্রাণীর ছবি প্রদর্শন করলে চাবুকপেটা বা কারাবরণের শাস্তি মাথা পেতে নিতে হতো।
সে সময় অধিকাংশ আফগান বক্স-ক্যামেরার মালিকই শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য তাদের ক্যামেরাসহ ছবি তোলার যাবতীয় সরঞ্জাম লুকিয়ে ফেলেন। তবে তালেবান নেতারা নিজেদের জন্য আইনের ব্যতিক্রম ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। নিজেদের ফটো আইডি বানানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। ফলে ছবি তোলার ব্যবসা চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হয় অল্প কয়েকজন আফগান ফটোগ্রাফারকে।
২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বাহিনী আফগানিস্তান হামলা করলে তালেবানের পতন হয়। এরপর ফের বিকশিত হয় ফটো শিল্প। পুরনো স্টুডিয়োগুলো ফের ছবি তোলার ব্যবসায় ফিরে আসে, সেইসাথে চাহিদা বাড়ায় অনেক নতুন স্টুডিয়োও খোলা হয়।
এই প্রতিবেদনে কাবুলের যে স্টুডিয়োর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে গিয়ে এনপিআরের প্রতিবেদক দেখতে পান অনেক রং-বেরঙের ছবি পড়ে আছে সেখানে। দেশ ছেড়ে পালানো আফগানদের ছবি সেগুলো—সৈনিক, সেনাপতি, শিশু, জনপ্রিয় গায়ক, নারী পুলিশ অফিসার, কবি, বিজ্ঞানী, শিল্পী। তাড়াহুড়ো করে দেশ ছাড়ায় কেউই ছবিগুলো নিয়ে যেতে পারেননি।
আরও কিছু পরিত্যক্ত ছবিতে দেখা যায় তালেবান সদস্যরা মাথায় মুকুট আর কোলে বন্দুক নিয়ে পোজ দিচ্ছে। স্টুডিয়ো মালিকরা যত্ন করে ছবিগুলো রেখে দিয়েছেন, যদি কখনও এগুলো নেওয়ার জন্য কেউ ফিরে আসে।
তালেবানের আগের শাসনামলে ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এবারের শাসনামলেও ছবি তোলা নিষিদ্ধ থাকবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে কাবুলের স্টুডিয়োগুলোতে এখনও অনেক পরিত্যক্ত ছবি রয়ে গেছে, যেগুলো আফগানিস্তানের গত প্রায় অর্ধশতাব্দীর সাক্ষী হয়ে আছে। দেশটির হারানো সময়ের মানুষ ও সংস্কৃতির গল্প বলে এই ছবিগুলো।
- সূত্র: এনপিআর