হিন্দু পুরোহিতের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরায় ভারতের শীর্ষ ফ্যাক্ট-চেকারের বিরুদ্ধে মামলা
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দেশটির শীর্ষ ফ্যাক্ট-চেকার ও সাংবাদিক মোহাম্মদ জুবায়েরকে জামিন দিয়ে 'অবিলম্বে মুক্তির' নির্দেশ দেওয়ার দুই বছর পর ফের আদালতে ফিরতে হয়েছে তাকে।
মঙ্গলবার উত্তর প্রদেশ পুলিশের দায়ের করা একটি নতুন মামলায় তার আবেদনের সংক্ষিপ্ত শুনানি করেন এলাহাবাদ হাইকোর্ট। তার বিরুদ্ধে 'ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার' অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
এই অভিযোগ জামিন-অযোগ্য। দোষী সাব্যস্ত হলে অন্তত সাত বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা, এমনকি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও হতে পারে।
ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজ-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জুবায়ের অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, 'আমার কাজের জন্যই আমাকে টার্গেট করা হচ্ছে।'
মঙ্গলবার শুনানি শুরু হওয়ার মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে বিচারকরা মামলা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেন। এর ফলে এখন অন্য কোনো মামলাটির আদালতে শুনানি হবে।
জুবায়েরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে গত ৩ অক্টোবর এক্স-এ (সাবেক টুইটার) একজন একটি পোস্টের কারণে। ওই পোস্টে তিনি বিতর্কিত হিন্দু পুরোহিত ইয়াতি নরসিংহানন্দের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন।
জুবায়েরের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা যায়, নরসিংহান্দ মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন।
৬০ বছর বয়সি নরসিংহানন্দ উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদের দাসনা দেবী মন্দিরের প্রধান। মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সহিংসতার আহ্বান জানিয়ে তিনি বারবার খবরের শিরোনাম হয়েছেন। ২০২২ সালে ইসলামবিদ্বেষী ও নারীবিদ্বেষী মন্তব্যের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় তিনি এক মাস কারাগারে ছিলেন।
জুবায়ের নরসিংহানন্দের ঘৃণামূলক বক্তব্য তুলে ধরে পোস্ট করার একদিন পর মন্দিরের বাইরে মুসলমানরা বিক্ষোভ করেন। পুলিশের বরাত দিয়ে পিটিআই জানিয়েছে, বিক্ষোভের সময় পাথর নিক্ষেপের অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অনেক মুসলিম নরসিংহানন্দের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর থেকে তাকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন বলেও কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। তবে পুলিশ বলেছে, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এর কয়েকদিন পরই নরসিংহানন্দের শতাধিক সমর্থক স্থানীয় থানা ঘেরাও করে জুবায়েরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
বিজেপির রাজনীতিবিদ ও নরসিংহানন্দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী উদিত্য ত্যাগীর অভিযোগের ভিত্তি পুলিশ জুবায়েরের বিরুদ্ধে মামলা নেয়।
প্রথমে জুবায়েরের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা, মানহানি এবং মিথ্যা তথ্য প্রদানের মতো কম গুরুতর অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে পুলিশ ভারতের নতুন আইন ভারতীয় ন্যায় সংহিতা-র ধারা ১৫২ যোগ করেছে। এতে অভিযোগ আনা হয়েছে, জুবায়ের 'ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও অখণ্ডতা বিপন্ন করছেন।'
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভিযোগ আনার ফলে পুলিশ এখন জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। জুবায়েরের আইনজীবী তার অন্তর্বর্তী জামিনের আবেদন করেছেন এবং মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেছেন।
জুবায়ের বলেন, তিনি একাই অনলাইনে নরসিংহানন্দের বক্তব্য পোস্ট করেননি। তার আগেই আরও অনেক সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সংবাদমাধ্যম ওই ভিডিও টুইটারে শেয়ার করেছে।
তিনি আরও বলেন, 'ক্রমাগত ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন, এমন একজন মানুষের অনুসারীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা করেছে পুলিশ। ঘৃণামূলক বক্তব্যের খবর তুলে ধরছে এমন মানুষের পেছনে লেগেছে তারা, অথচ ঘৃণামূলক বক্তব্য দেওয়া মানুষ মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে।'
'যেসব মানুষ সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করছে, তাদের কণ্ঠ রোধ করার প্রচেষ্টা এটি,' বলেন তিনি।
জুবায়েরের সহকর্মী এবং অল্টনিউজের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেন, কর্তৃপক্ষের জুবায়েরের পেছনে লাগার কারণ তার কাজের ধরন এবং তার কাজের প্রভাব।
প্রতীক বিবিসিকে বলেন, 'প্রায় দুই মাস পর কেন তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর অভিযোগ আনা হলো? শুধু নরসিংহানন্দ আর তার সমর্থকদের ওর পেছনে লাগেনি—আসলে সরকারও ওর পেছনে লেগেছে।'
মানবাধিকার ও সংবাদকর্মীদের সংগঠনগুলো জুবায়েরের বিরুদ্ধে আনা এই মামলার কঠোর সমালোচনা করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়া বলেছে, আইনকে ব্যবহার করে কীভাবে বাক-স্বাধীন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, গায়ক, অভিনেতা ও লেখকদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও নিপীড়ন করা হয়, তার উদাহরণ জুবায়েরের বিরুদ্ধে করা এই মামলা।
এর আগে ২০২২ সালেও জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করে সমালোচনার শিকার হয়েছিল ভারত সরকার। ওই সময় তাকে তিন সপ্তাহের বেশি সময় কারাগারে কাটাতে হয়েছিল।
২০১৮ সালের একটি টুইটের জন্য জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ওই টুইটে ১৯৮০-এর দশকের একটি জনপ্রিয় বলিউড সিনেমার স্ক্রিনশট ছিল। পুলিশ দাবি করেছিল, এতে 'হিন্দু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত' লেগেছে। পরে উত্তর প্রদেশের পুলিশও ষড়যন্ত্র ও বিদেশি অর্থায়ন পাওয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
বিজেপির মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া অভিযোগ করেছিলেন, জুবায়েরের ফ্যাক্ট-চেকিং 'পক্ষপাতদুষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এছাড়া তার টুইট 'বিপুলসংখ্যক হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে' বলেও অভিযোগ তোলেন গৌরব।
তবে ওই সময় অনেকে বলেছিলেন, বিজেপির মুখপাত্র নুপুর শর্মার ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্যের সঙ্গে জুবায়েরের গ্রেপ্তারের যোগসূত্র ছিল। দ্য হিন্দু বলেছিল, মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে করা '(নুপুর) শর্মার জঘন্য মন্তব্যের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তার মূল্য চুকাতে হয়েছে' জুবায়েরকে। জুবায়েরের গ্রেপ্তারকে সংবাদমাধ্যমটি সত্য তুলে ধরা 'ফ্যাক্ট-চেকারদের বিরুদ্ধে সরকারের অসহিষ্ণুতা'র নজির হিসেবে উল্লেখ করেন।
আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘও জুবায়েরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর (আরএসএফ) তথ্যমতে, বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে ভারতের অবস্থান ১৮০ দেশের মধ্যে ১৫৯তম। এ সূচকে দেশটির অবস্থান দিন দিন নিচে নামছে।
আরএফএফ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা করা সাংবাদিকরা অনলাইনে নিয়মিত হয়রানি, হুমকি-ধমকি, শারীরিক আক্রমণ এবং গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন।
অতীতে অবশ্য ভারত সরকার এই সূচক নিয়ে আপত্তি তুলে বলেছে, সূচকটি তৈরির পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ।