যে কারণে তলানিতে ভারতীয় রুপির দর
অস্থিতিশীল ভারতের মুদ্রাবাজার, গত তিন দিনে রেকর্ড হারে কমেছে রুপির দর। গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) ভারতে প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে ৮৪ দশমিক ৭৫ রুপিতে গিয়ে ঠেকে।
সোমবার ভারতের জিডিপি তথ্য প্রকাশের পর রুপির ০.২৫% পতন ঘটে, যা গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় দরপতন।
মার্কিন ডলারের বিপরীতে এটি ভারতীয় রুপির রেকর্ড সর্বনিম্ন দর। অনেকে আশঙ্কা করছেন রুপির দরপতন আরও বেশি হতো। তবে মঙ্গলবারের দরপতনের পর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (আরবিআই) হস্তক্ষেপ এবং বিদেশি ব্যাংকের ডলার বিক্রির ফলে তা কিছুটা থামানো গেছে।
ফরেক্স ট্রেডাররা জানান, রুপির মান কমার প্রধান কারণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্রিকস মুদ্রা নিয়ে মন্তব্য, ইউরোপীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সূচক এবং বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের (এফপিআই) প্রবাহে সংকোচন প্রভাব রাখছে।
গত ৩০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, তার আমলে ব্রিকস সদস্যভুক্ত দেশগুলোকে ডলারের পরিবর্তে অন্য কোনো মুদ্রা ব্যবহার না করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, নইলে তাদের ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
এর সঙ্গে, পূর্বাভাস ছিলো চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে, সেখানে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.৪ শতাংশ হারে; যা ১৮ মাসের সর্বনিম্ন। গত সপ্তাহে সরকার এ তথ্য প্রকাশ করেছে, যা রুপির দামকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে।
আনন্দ রাঠি ওয়েলথের ডিরেক্টর নবীন মাথুর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রুপির ওপর বর্তমান চাপ মূলত ডলারের শক্তিশালী অবস্থানের জন্য।
তিনি বলেন, 'গত কয়েক দিনে আমরা যা দেখেছি, তা মূলত ডলারের কারণে। মার্কিন নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু নীতিগত পদক্ষেপ ঘোষণা করেছেন যা ডলার সূচকের জন্য ইতিবাচক হবে। এর ফলে ডলারের মান উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।'
'এই পরিস্থিতি রুপির মানকে নিচের দিকে টেনে এনেছে। তবে সামনের দিনগুলোতে মুদ্রার অবস্থা নির্ভর করবে বিভিন্ন বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর', যোগ করেন নবীন মাথুর।
বাজার সংশ্লিষ্টরা অবশ্য, ৬ ডিসেম্বরের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (আরবিআই) আসন্ন মুদ্রানীতির জন্য অপেক্ষা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের নীতি সম্ভবত মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ওপর মনোযোগ দেবে।
রুপির দরপতন নিয়ে ভারতের স্বস্তিকা ইনভেস্টমার্টের সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যানালিস্ট প্রবেশ গৌর বলেছেন, 'রুপির মান কমে যাওয়ায় আমদানি খরচ বাড়বে এবং মুদ্রাস্ফীতির হারও বেড়ে যেতে পারে। এই পতন ভারতের অর্থনীতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।'
গৌর আরও উল্লেখ করেন, এর ফলে গ্রাহকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এছাড়া, বৈদেশিক ঋণের খরচ বাড়তে থাকায় এই ধরনের ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাড়তি চাপ তৈরি হবে বলে তিনি সতর্ক করেছেন।
অন্যদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরি সোমবার সংসদে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও রুপি আজও এশিয়ার অন্যতম সেরা কার্যকরী মুদ্রা, যা ভারতের শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির দিকে ইঙ্গিত করে।
তিনি আরও বলেন, '২০২৪ সালের ১৯ জানুয়ারী পর্যন্ত ডলার সূচক প্রায় ৪.৮ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২২ নভেম্বরে ১০৮.৭ ছুঁয়েছে—যা এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, যার ফলে উদীয়মান বাজারের মুদ্রার ওপর চাপ পড়েছে।'
তবে মুদ্রার অবমূল্যায়ন সাধারণত রপ্তানির প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, তবে একইসঙ্গে আমদানি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আরবিআই বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো মনিটর করে, যা ডলার-রুপি বিনিময় রেটের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে গৌর জানান, রুপির মান কমে গেলে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে।
তিনি বলেন, 'রুপির মান কখন বাড়বে তা নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ এটি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মন্দা বা ডলারের মান কমে যাওয়া রুপির জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। একইভাবে, শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি খাতের উন্নতি রুপির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। আরবিআই বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে হস্তক্ষেপ করে রুপিকে সহায়তা করতে পারলেও, তা সাময়িক সমাধান।'