অতীতে কোনো প্রার্থী হার মেনে নিতে অস্বীকার করেননি, এখন?
২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। জনরায় অস্বীকার করে বলেছেন বিজয় তারই হয়েছে। একাজটি তিনি করেছেন, নির্ধারণী কিছু রাজ্যে ভোট গণনা চলাকালেই। যখনই বাইডেন এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছিলেন, ঠিক তখনই জালিয়াতির অভিযোগ তুলে পুরো মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তিনি।
নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল মানবেন না, এমন কথাই বলেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীকে সৌজন্যমূলক অভিনন্দন জানানো দূরে থাক, তাকে নিয়ে করছেন নতুন নতুন কটূক্তি। শান্তিপুর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে নির্বাচনের ফল নিয়ে ইতোমধ্যেই আদালতে মামলা করেছে ট্রাম্প শিবির।
পরাজয়কে জোচ্চুরি বলা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনরায় মেনে না নেওয়া, দুটো ঘটনাই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম।
তবে মার্কিন জাতির ইতিহাসে অনেক তীব্র প্রতিযোগীতার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই হয়েছে। তা নিয়ে আংশিক বিবাদও হয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই এমন নির্বাচনের ঘটনা বেশি। প্রথমেই উল্লেখ করা যায়; রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ আর ডেমোক্রেট আল গোরের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা।
ভোট গণনা চলাকালেই প্রতিপক্ষ বুশের প্রতি পরাজয় মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান আল গোর। পরে অবশ্য যখন দুজনের মধ্যে ইলেক্টোরয়াল ভোটের ব্যবধান কমে আসে, তক্ষনাৎ নিজ আহ্বান প্রত্যাহার করে নেন।
এনিয়ে তাদের প্রথম বাক্য বিনিময় সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও, দ্বিতীয় সংলাপ ছিল কিছুটা উত্তেজনাময়। গোর তখন বুশকে শান্ত করার উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, 'এনিয়ে তোমার উত্তেজিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।'
এই ছিল আধুনিক সময়ে বাদানুবাদের ইতিহাস। অতীতে নির্বাচনে হারের পর ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেননি কোনো রাষ্ট্রপতি। ভোট গণনা এবং নির্বাচনের অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষে তারা জনগণের ইচ্ছেকে সাদরে গ্রহণ করেছেন।
তবে মার্কিন গণতন্ত্রের প্রথম শতাব্দীতে নির্বাচনে হারের পর শান্তিপূর্ণ সমঝোতা সহজে হয়নি। হেরে যাওয়া প্রার্থীদের সেই অস্বীকার কীভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল মেনে নেওয়ায় রূপ নিল এবং কীভাবেই বা তাদের ফল মেনে নেওয়ার ঘোষণা একটি চিরাচরিত প্রথায় রূপ নিল- সেই ইতিহাসই এখানে তুলে ধরা হলো;
হার মেনে নেওয়ার প্রথা যেভাবে শুরু:
১৮ শতক থেকেই শান্তিপূর্ণভাবে নব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের রীতি শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস পুনঃনির্বাচনের লড়াইয়ে যান। তখন উত্তরসূরি টমাস জেফারসনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এড়াতে তিনি সকাল সকাল ঘোড়ার গাড়ি চেপে রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি ত্যাগ করেন।
নবীন মার্কিন গণতন্ত্রের ওই সময়ে কিছু প্রার্থী তাদের প্রতিপক্ষকে বিজয়ের অভিনন্দন জানিয়ে চিঠিও লিখতেন, জানান মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ডিন জন আর. ভাইল। অতীতে প্রার্থীদের নির্বাচনে হার স্বীকার করে দেওয়া বক্তৃতার ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছেন এ বিশেষজ্ঞ।
ভাইল বলেন, ১৮ শতকের শেষভাগে এসে হার স্বীকার করে দেওয়া সম্ভাষণ আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেয়। বিশেষ করে, ১৮৯৬ সাল থেকে। ওই নির্বাচনে রিপাবলিকান উইলিয়াম ম্যাক কিনলি ডেমোক্রেট প্রার্থী উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানকে পরাজিত করেন।
পরবর্তীতে লেখা ব্রায়ানের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, নির্বাচনের রাত ১১টা থেকেই তার ভিতরে উদ্বেগ কাজ করছিল। তারপর কয়েকদিন নানা রাজ্যে যখন ভোট গণনা চলছিল তখন তিনি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বৃহস্পতিবার বিকেল নাগাদ বুঝতে পারেন, তার হার প্রায় নিশ্চিত। সঙ্গেসঙ্গেই টেলিগ্রাম করে কিনলেকে অভিনন্দন বার্তা পাঠান: 'নির্বাচনে নেমে আমরা মার্কিন জনতার কাছে নিজেদের ভাগ্য সঁপে দিয়েছিলাম। তাদের ইচ্ছাই এখানে আইন।'
আর এভাবেই শুরু হয় হার মেনে অভিনন্দন জানানোর প্রথাটি। ব্রায়ান কিন্তু শুধু সৌজন্যের খাতিরেই কাজটি করেছিলেন। বিষয়টি আনুষ্ঠানিক হয়ে যাবে, সেটা ছিল তার কল্পণার অতীত।
এব্যাপারে তিনি লিখেছেন, ''বার্তাটি ছিল খুবই সাধারণ। এতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু ছিল না। আমি তো আর তার সাথে কুস্তি লড়তে আসিনি। আমরা দুজনে শুধু ভিন্ন দুই রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেছি মাত্র। আর জনগণ যেকোনো একজনকে বেঁছে নিয়েছেন। ব্যাস! এটুকুই তো ব্যাপার।''
ব্রায়ান যতই সাধারণ বলুন এরপর থেকে নির্বাচনের ফল স্পষ্ট হওয়া মাত্রই প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দেওয়ার প্রথা চালু হলো। ক্ষমতায় থাকাকালেই যারা নির্বাচনে হেরে যান, সেসব রাষ্ট্রপতিও এটি মেনে চলা শুরু করেন।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; ১৯১২ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি উইলিয়াম হাউওয়ার্ড টাফটের কথা। ১৯৩২ সালেও রিপাবলিকান প্রার্থী হার্বার্ট হুভার তার ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টকে নির্বাচনী জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন সব কাজে তাকে সহযোগীতা করবেন। পরে অবশ্য রুজভেল্টের একজন কট্টর সমালোচকে পরিণত হন হুভার।
রিপাবলিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৬০ সালে ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বী জন এফ. কেনেডির কাছে হার মেনে নেন। নিক্সন সিনেট কমিটির প্রধানও ছিলেন। তিনি নিজে ইলেক্টোরয়াল ভোট গুণে পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত করেন।
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ ওই নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর হাওয়াই রাজ্য নিক্সনের পক্ষে ইলেক্টোরাল ভোট দেয়। কিন্তু, তা ফলাফলে বড় পরিবর্তন আনবে না স্বীকার করে, ওই ভোটও কেনেডির পক্ষে যাক এমন প্রস্তাব দেন নিক্সন। সিনেট ওই প্রস্তাবে অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়।
এব্যাপারে ভাইল বলেন, ''আমাদের সাংবিধানিক ব্যবস্থায় সৌজন্যের এমন অমায়িক প্রদর্শন হয়তো খুব কমই ঘটেছে। এর মাধ্যমে হেরে যাওয়ার পরও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে সম্মান জানানোর মার্কিন ঐতিহ্যটির মূল্যায়ন করা হয়।''
- সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক