একের পর এক মহড়া দিয়ে ইরানকে যে বার্তা দিচ্ছে ইসরায়েল
কয়েকদিন আগেই মার্কিন যুদ্ধজাহাজের সঙ্গে লোহিত সাগরে প্রথমবারের মতো যৌথ নিরাপত্তা অভিযানের মহড়া দিয়েছে ইসরায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের নৌবাহিনী।
এর আগে গত মাসে ইসরায়েলের বন্দর শহর ইলাতের উত্তরে একটি মরুভূমির বিমানঘাঁটিতেও ৭টি মিত্র দেশের সঙ্গে যুদ্ধবিমানের মহড়া চালিয়েছিল ইসরায়েল।
এ ধরনের মহড়ার প্রধান উদ্দেশ্য হল, ইরানকে একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা পাঠানো। কারণ সম্প্রতি ইরানও তার কৌশলগত জোটের ওপর জোর দিচ্ছে ও সামরিক মহড়া পরিচালনা করছে।
এদিকে, ইরানের পারমাণবিক ক্ষেত্রগুলোর বিরুদ্ধে হামলার জন্য ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করতে সরকার দেড় বিলিয়ন ডলার (১.১ বিলিয়ন ইউরো) বরাদ্দ দিয়েছে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সতর্কবার্তা তো আসছেই।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে ইসরায়েলের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে।
ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, "ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলের কোনো আগ্রহ নেই; তবে, আমরা ইরানকে কোনোভাবেই পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করতে দেব না। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সব ধরনের বিকল্প পথ ও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।"
ইরানের পরমাণু কর্মসূচির লাগাম টানতে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ৬ জাতির মাঝে স্বাক্ষরিত হয় জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ) বা সংক্ষেপে পি৫+১ নামে একটি পরমাণু চুক্তি। তবে, মার্কিনমুল্লুকে ডেমোক্র্যাট থেকে রিপাবপলিকানদের হাতে ক্ষমতার পালাবদলে সেই চুক্তি অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিন্তু পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চলতি বছরের শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জো বাইডেন দেশটির ক্ষমতায় আসার পর আবারও পুনরুজ্জীবিত হওয়ার আশা দেখছে স্থগিত থাকা সেই পরমাণু চুক্তি। চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় পুনরায় আলোচনা হতে চলেছে এই চুক্তি নিয়ে।
নতুন করে পরমাণু আলোচনার তারিখ নির্ধারণের সঙ্গে সঙ্গেই ইরান ২৫ কেজি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরমাণু বোমার জন্য প্রায় এই পরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিরই প্রয়োজন হয়।
তবে তেহরান জোর দিয়েই বলছে, তাদের উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ।
শেষ হয়ে আসছে সময়
ইসরায়েলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির বর্তমান সিনিয়র ফেলো ইয়াকভ আমিদ্রর ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে প্রথমবারের মতো ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে সতর্ক করেছিলেন।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে তিনি বলেন, "ইসরায়েল অবশ্যই এমন পরিস্থিতি মেনে নেবে না, যেখানে ইরান পারমানবিক বোমা বানিয়ে ফেলবে; এটি কীভাবে বন্ধ করা যায় শীঘ্রই সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।"
ইসরায়েল অন্তত দুবার তাদের শত্রুপক্ষের পারমানবিক চুল্লি ধ্বংস করার জন্য একাকী পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে একটি ছিল ১৯৮১ সালে ইরাকে এবং আরেকটি ২০০৭ সালে সিরিয়ায়।
কিন্তু এখন অনেক বিশ্লেষক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, দেশটি ইরানের উন্নত পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করার ক্ষেত্রে একাকী একটি জটিল অভিযান চালাতে সক্ষম হবে কিনা। কারণ ইরানের পারমানবিক কর্মসূচির কিছু ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোও রয়েছে।
আমিদ্রর এমন সন্দেহ আমলে নিয়ে বলেন, "একটি হামলা যে ইসরায়েলকে একটি জটিল যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে তা দেশটির সবাই বোঝে।"
এদিকে, ইরান এ ধরনের হামলার হুমকির প্রতিবাদে 'মারাত্মক জবাব' দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ধারণা করা হয়, এই ইস্যুতে যুদ্ধ বেধে গেলে ইরান তার নিজস্ব বাহিনীর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যচ্যজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তাদের বিভিন্ন সহযোগী গোষ্ঠীগুলোকেও (যেমন- লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী ও গাজা উপত্যকার জিহাদীগোষ্ঠী) ব্যবহার করবে।
তবে উচ্চ ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের অনেকেই মনে করেন, একটি হামলা যদি ইরানের পারমানিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কয়েক বছর পিছিয়েও দিতে পারে, তাহলে একটি হামলা চালানো যৌক্তিক।
অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখনও শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে এগোতে আগ্রহী।
গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের গবেষণা বিভাগের সাবেক প্রধান সিমা শাইন বলেন, "আমি আশা করি, আলোচনার কূটনৈতিক উদ্যোগ সফল হবে; তবে এই মুহূর্তে আমি এটিকে খুব বেশি কার্যকর মনে করছি না।"
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন ইরানকে সরাসরি আগে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রের সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল সরকার।
গোপন পদক্ষেপ
ওয়াশিংটনের মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের আরেক প্রবীণ ইরান বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ভাটাঙ্কা। তিনি পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি তেহরানের গভীর আদর্শিক প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছেন।
তার মতে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস সত্ত্বেও, ইরান অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চাপ কমাতে পি ৫+১ বা জেসিপিও-তে ফিরে আসতে চায়।
ভাটাঙ্কার মূল কথা হলো, ইরান আসলে পারমাণবিক অস্ত্র চায় না।
তিনি বলেন, "এটি একটি বিকল্প যেটা তারা পেতে চায়, তবে এর মূল উদ্দেশ্য অস্ত্র তৈরি করা নয়। ইরান পারমাণবিক সক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে থাকতে চায়।"
তিনি আরও বলেন, "ইরান আমেরিকাকে বোঝাতে চায়, পারমানবিক বিশ্বে ইরান একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র এবং এর শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটবে না।"
এদিকে, ইসরায়েলের হামলার হুমকিও তিনি বিশ্বাস করেন না। তার পরামর্শ, ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতি ঠেকাতে ইসারয়েলের উচিত তাদের গোপন প্রচেষ্টাই আরও বেশি কার্যকর করে তোলা।
অস্ত্র বিস্তারের ভয়
পরবর্তীতে কী ঘটতে চলেছে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেক মতপার্থক্য থাকলেও, তারা একটি সাধারণ বিষয়ে একমত; ইরানের পারমাণবিক পরিকল্পনা নিয়ে আসন্ন আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নির্ধারিত হয়েছে। এই অস্থিতিশীল অঞ্চলের জন্য এর চেয়ে বেশি ঝুঁকি আর হতে পারে না বলে একমত তারা।
ইরান যদি তার নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্রাগার তৈরি করে, তবে অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন-সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিশরও এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।
ওয়াশিংটন বলছে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে 'অনন্তকালের যুদ্ধ' বন্ধ করতে চায়। তবে তারা সতর্ক করেছে, ইরানের ক্ষেত্রে তারা 'অন্য বিকল্পের' দিকেও গুরুত্ব দেবে।
সামরিক শক্তি প্রদর্শনের প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে, সম্প্রতি মার্কিন-ইসরায়েল যুদ্ধবিমান মহড়া শেষ হয়েছে হয়েছে। মার্কিন এই যুদ্ধবিমান ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক সাইটগুলোতে হামলা চালাতে সক্ষম।
তবে ইরানের পরমাণু অস্ত্র অর্জন ঠেকাতে কৌশলবিদরা আসলেই যেটি চান, সেটির জন্য ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা জরুরি কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি