এশিয়া কি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার পথে?
বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী চ্যালেঞ্জসমূহ কীভাবে সমাধান করা যায়, সে সম্পর্কে ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখকদের নেয়া বিশেষ সাক্ষাতকার সিরিজের একটি অংশ এটি। স্বচ্ছতা ও সংক্ষিপ্তকরণের লক্ষ্যে এটি সম্পাদনা করা হয়েছে।
ক্লারা ফেরেইরা মার্কুইজ: ২০০৩ সালে যখন একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বে, সে সময় আপনি নিজের ক্যারিয়ার শুরু করার উদ্দেশ্যে সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করতে এবং পরবর্তী মহামারির জন্য প্রস্তুত থাকার লক্ষ্যে হং কং বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করেন। কোভিড-১৯ যখন আঘাত হানলো, এরই মধ্যে আপনার দলটি অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু ২০১৯ সালে এসে যখন দেখলেন, অবশেষে সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত এসেছে; কিন্তু আপনার সকল পরামর্শ মানা হচ্ছে না, তখন আপনার কি মনে হয়েছিল?
বেন কাউলিং (হং কং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ এর অধ্যাপক): জানুয়ারির মাঝামাঝিতে এসে আমরা অনুধাবন করি যে এটা একটা মহামারির আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। তখন আমরা চীনের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বিভাগের সঙ্গে মিলে প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত ডেটার উপর কাজ করি এবং সারা বিশ্বে তা সতর্কবার্তা হিসেবে প্রচার করি। সে সময় যখন আমি ইউরোপ ও আমেরিকায় আমার বন্ধুবান্ধব ও সহযোগীদের সঙ্গে কথা বললাম, তাদেরকে বিশেষ চিন্তিত মনে হলো না। তাদের রোগ নির্ণয়ের জন্য আলাদা দল আছে, যেহেতু তাদের দেশে তখনো রোগ ছড়ায়নি, তাই তারা ফ্লু নিয়েই কাজ করতে লাগলো। কিন্তু আমরা ততদিনে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে গেছি এবং রোগের মাত্রা ও সংক্রমণজনিত উপসর্গ বুঝার চেষ্টা করছি।
শুরুর দিকে আমার প্রথম আইডিয়া ছিল মাস্ক ব্যবহার করা। আমি বলিনি যে মাস্কই সব রোগ প্রতিরোধ করবে, কিন্তু এগুলো সংক্রমণ কমাবে নিশ্চিত। আর হংকংয়ে এই নিয়ম বেশ ভালোভাবেই মানা হয়েছে।
সিএফএম: কিন্তু এশিয়ার অনেক দেশেই এখনো আগের চেয়ে বেশি সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। প্রথম দিকে কোভিড মোকাবিলায় সফল হওয়া সত্ত্বেও এশিয়ার দেশগুলোতে কেন এখন মারাত্মক সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে?
বিসি: আমরা সংক্রমণ এড়াতে ভালো কৌশলই অবলম্বন করেছি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ কড়া বিধিনিষেধ পালনে হাঁপিয়ে উঠে। ফলে ভাইরাস তার জায়গা খুঁজে নেয়।
এই মুহূর্তে এশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো টিকাদানের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া। এশিয়ার কিছু অংশে প্রয়োজনের তুলনায় ভ্যাকসিন সরবরাহ কম, আবার কিছু অংশে সরবরাহ বেশি থাকলেও জনসাধারণ ভ্যাকসিন নিতে অনাগ্রহী। এর ফলে বিশ্বে ভাইরাসের প্রবাহ থামাতে আরো বেশি সময় লেগে যাবে।
ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার ক্ষেত্রে ইমিউনিটি বাড়ানো মানে কোভিড-১৯ এর যাত্রা থামানোর প্রচেষ্টা, অন্তত স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর ভেঙ্গে পড়বে না। একবার দেশে টিকাদানের হার বেড়ে গেলে, সংক্রমণ হয়তো একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে না; কিন্তু এতে করে হাসপাতালগুলোও আর ভঙ্গুর হয়ে পড়বে না এবং মানুষ যথেষ্ট সুরক্ষা পাবে। ইউরোপ ইতিমধ্যেই এই কৌশল নিয়ে জয়ের পথে, কিন্তু এশিয়ার ক্ষেত্রে তাতে আরো সময় লাগবে; হোক সেটা হংকং, তাইওয়ান কিংবা চীন।
সিএফএম: সাম্প্রতিক কোভিড সংক্রমণের ঢেউ স্বল্প ও উচ্চ আয়, দুই ধরনের দেশগুলোতেই আঘাত হেনেছে। এশিয়ার ধনী দেশগুলোর মধ্যে আছে তাইওয়ান, যেখানে টিকাদানের হার অত্যন্ত কম। হংকং বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো কি এখন আত্মতুষ্টিতে ভোগার ঝুঁকিতে রয়েছে?
বিসি: আত্মতুষ্টি আসলেই একটি ইস্যু আমাদের সামনে। হংকংয়ে আমাদের অনেক ভ্যাকসিন রয়েছে। যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিই এখানে ভ্যাকসিন পাবেন, তবে সেরকম কোনো তাড়া দেখা যাচ্ছে না। এমনটা নয় যে তারা ভ্যাকসিন নিতেই চাইছে না, শুধু জরুরি মনে করছে না এখনো। আমাদের জরিপে দেখা গেছে ২০ শতাংশ মানুষ একেবারেই ভ্যাকসিনে অনাগ্রহী। তবে বাকি ৮০ শতাংশ মানুষ হয় ইতিমধ্যেই ভ্যাকসিন নিয়েছে, আর নাহয় নেয়ার পরিকল্পনা করছে।
ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধা বোধ করার মূল কারণ হচ্ছে, এর দ্বারা তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া যায়না। হয়তোবা এক মাস বা দুই মাস পরে গিয়ে তা কার্যকরী হয়।
সিএফএম: ভয়ের আরেকটি কারণ হলো বিপরীত প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা যা হংকংয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা দেখা গেছে। কিন্তু গত দুই বছরের রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে মানুষ এমনিতেই সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছে না।
বিসি: আমি জানি যে আমাদের আরো স্বচ্ছতা বজায় রাখা উচিত। কিন্তু যেহেতু ভ্যাকসিন নেয়া ও ভ্যাকসিনে কাজ না হওয়ার মধ্যে সরাসরি কোনো সংযোগের প্রমাণ নেই, তাই মানুষ ভাবছে যে ভ্যাকসিন নেয়ার পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এমনকি হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকও হতে পারে। আর বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দিলে, তাদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে এসব লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
কিন্তু বিশ্বের অন্য সব দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখি যে ভ্যাকসিনের তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। ইসরায়েলে লাখ লাখ বায়োএনটেক ভ্যাকসিন দেয়া হয়েছে এবং এর কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া হয় কিনা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, কিন্তু খারাপ কিছুই হয়নি।
সিএফএম: এটা খুবই অবাক করা বিষয় যে হংকংয়ে অপেক্ষাকৃত বৃদ্ধ ব্যক্তিরা ভ্যাকসিন নিয়েছেন সবচেয়ে কম, এর কারণ কি ভীতি বা অন্যকিছু?
বিসি: হং কং এ প্রথম ডোজ নিয়েছে ২০% মানুষ, কিন্তু ৮০ বছরের বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৩%। এর কারণ তারা নানা ধরনের ভুল তথ্য পায়, কেউ কেউ তাদের পরামর্শ দেন ভ্যাকসিন না নিতে। আবার সামান্য অসুস্থতা থাকলেও ভয়ে তারা ভ্যাকসিন নেন না। কিন্তু অন্য সব দেশেই দেখা গেছে, যেকোনো শারীরিক অবস্থায়ই ফিট থাকলেই ভ্যাকসিন নেয়া যাবে এবং এতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমি বলবো যে আপনি ভ্যাকসিন নেয়ার আগে একবার ডাক্তার দেখান।
দুর্ভাগ্যবশত হংকং এখন জিরো কোভিড অবস্থানে, তাই মানুষ চিন্তিত নন। কিন্তু যদি কোনোভাবে আবার এখানে কোভিড ফিরে আসে, তাহলে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, এমন ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হবেন, মৃত্যুও হতে পারে। ভ্যাকসিন নেয়া থাকলে তা এড়ানো যাবে।
সিএফএম: যদি একান্তই কিছু মানুষ ভ্যাকসিন নিতে না চায় কিংবা তাদের বোঝানো না যায়, তখন নীতিনির্ধারকরা আর কী পন্থা অবলম্বন করতে পারেন?
বিসি: আমেরিকা ও ইউরোপে এখন প্রতিটি মানুষকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে। কেউ যদি ভ্যাকসিন নিতে না চায়, এটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং আমাদের তাকে সম্মান করা উচিত। কিন্তু ভারত, ইতালি ও নিউইয়র্কে আমরা যা দেখেছি, তাতে বোঝা যায় যে জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্ব আছে। তাই উচ্চ টিকাদান হার না থাকলে কোভিডের মাত্রা বাড়বেই, তখন সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউনও আবার দিতে হবে। তখন হয়তোবা অনাগ্রহী ব্যক্তিরা ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হবেন।
ইউরোপ-আমেরিকার ক্ষেত্রে কাউকে এখন ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার দরকার নেই বলে আমি মনে করি। কিন্তু এশিয়ার ক্ষেত্রে তা নয়।
সিএফএম: তার মানে কি এই যে সাময়িক বিধিনিষেধ আবার স্থায়ী করা হবে এবং হংকংয়ে ও তাই করা হতে পারে?
বিসি: হংকংয়ে জিরো কোভিড থাকায় আমরা কিছুটা আটকে রয়েছি। মূল ভূখণ্ড চীনকে অনুসরণ করছি আমরা। এক্ষেত্রে চীনে এখন যে হারে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে তা চলতে থাকলে তারা আর এ বছর শেষে জিরো কোভিডের কথা ভাববে না। বরং তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবে। হয়তো আবার কোভিডের আক্রমণের সম্ভাবনা থাকবে, কিন্তু বড় রকম কোনো হুমকি আর থাকবে না।
এরকম হলে হংকং খুবই আলাদা হয়ে যাবে। কারণ আমরা এখনো কোভিডকে পুরোপুরি বিদায় করতে পারিনি। আমরা বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে প্রচুর ভ্যাকসিন আছে, তবুও টিকাদান হার কম এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছি না।
সিএফএম: আপনি আগেও সার্স নিয়ে কাজ করেছেন, এত এত তথ্য থাকার পরেও আমরা মহামারিতে নানা রকম ভুল করেছি। আমরা কি আগামী দিনে আরেকটা মহামারি মোকাবিলায় প্রস্তুত?
বিসি: সার্স যদি কোভিড-১৯ এর মত ভাইরাস হতো তাহলে তা আরো ধ্বংসাত্বক হতো। আমাদের আসন্ন দুর্যোগের জন্য ভালো প্রস্তুতি ছিলনা, ভাইরাস আবারও আসতে পারতো এবং আমাদের এমআরএনএ প্রযুক্তি ছিল না।
এখন ভ্যাকসিন উৎপাদনে দ্রুত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে। গণ টিকাদান কর্মসূচিতে প্রথমবারের মত এমআরএনএ ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন আমরা জানি যে কীভাবে এরকম সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হয়, সম্ভাব্য বিকল্প কী কী এবং তাতে কেমন খরচ হয়। আগামী ৫, ১০ বা ১৫ বছরে যদি আবারও আমরা এমন মহামারির সম্মুখীন হই, আমি বলবো যে তখন আমরা আরো ভালো প্রস্তুত থাকবো। কোভিড-১৯ এর ক্ষয়ক্ষতি থেকে শিক্ষা নিয়ে, পর্যাপ্ত নজরদারির মাধ্যমে এর উৎস বন্ধ করতেও সক্ষম হবো হয়তো। তখন ভ্যাকসিনও অনলাইনে আসবে খুব দ্রুত, কারণ এমআরএনএ প্রযুক্তিতে শুধু স্ট্রেইনকে হালনাগাদ রাখতে হয়। তখন ভ্যাকসিনের উৎপাদনও থাকবে অনেক বেশি।
আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস-সম্পর্কিত ভাইরাসজনিত মহামারী থেকে নিশ্চিতভাবে অনেক কিছু শিখেছি। সে কারণেই ভারতে আবারও দ্বিতীয় তরঙ্গের আঘাত হানা দেখে আমরা এতটা ব্যথিত। এখন আমাদের প্রয়োজন অন্য কোনো উৎস থেকে যেন মহামারী না আসে, তা লক্ষ্য রাখা। কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে আমরা এই লড়াইয়ে প্রায় সফল বলা চলে, শুধু আরেকটু পথ পাড়ি দিতে হবে।
- (ক্লারা ফেরেইরা মার্কুইজ ব্লুমবার্গে পণ্য ও পরিবেশগত, সামাজিক ও শাসনপ্রক্রিয়া সম্পর্কিত ইস্যু নিয়ে মতামত কলাম লেখক। এর আগে তিনি রয়টার্সের ব্রেকিংভিউস-এ সহযোগী সম্পাদক এবং সিঙ্গাপুর, ভারত, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও রাশিয়ায় রয়টার্সের প্রতিনিধি ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন।)
- উপরোক্ত আর্টিকেলটি প্রথম bloomberg.com এ বিশেষ লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়।