এয়ারলাইন্সগুলোর সামনে টিকা পৌঁছে দেওয়ার শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
মহামারিতে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হয় আকাশপথে পরিবহনের ব্যবসা। এয়ারলাইন্সগুলোর সামনে দেখা দেয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। কমিয়ে আনা হয় সচল উড়োজাহাজের সংখ্যা।
এমন প্রভাব থেকে মুক্ত ছিল না জার্মানির সবচেয়ে বড় বিমান পরিবহন সংস্থা-ডয়েচে লুফথান্সা এজি।
তারপরও, ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে প্রতিষ্ঠানটির হিমাগারলোতে চলছে ভিন্ন রকমের ব্যস্ততা। উড়োজাহাজ সংখ্যা আগের চেয়ে কম হলেও তাদের সামনে এখন কোভিড-১৯ টিকা সরবরাহ করে বিশ্বমারীর রাশ টেনে ধরার চ্যালেঞ্জ। তারই প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে।
শুধু যাত্রী নয়, লুফথান্সা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আকাশপথে মালামাল পরিবহনকারী সংস্থাও। ফাইজার ইঙ্ক, মডের্না ইঙ্ক ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা পিএলসি'র তৈরি টিকা রেকর্ড সময়ে তৈরি হয়ে যাবে- এমন অনুমানে তারা গত এপ্রিল থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে।
তাদের বহরে আছে এমডি-১১ ও ১৫টি বোয়িং ৭৭৭ মালামাল পরিবহনকারী বিমান। সঙ্গে যাত্রীবাহী বিমানও আছে অনেক। এসব আকাশযানের কার্গো হোল্ডে কীভাবে বেশি পরিমাণে অত্যন্ত আবশ্যক এই পণ্য পরিবহন করা যায়, তারই পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে ২০ সদস্যের একটি টাস্ক ফোর্স।
লুফথান্সার বৈশ্বিক এ প্রচেষ্টায় নেতৃত্বদানকারী থরসটেন ব্রাউন বলেন, 'কীভাবে আমরা টিকা পরিবহনের পরিমাণ বাড়াতে পারে, সেটাই বড় প্রশ্ন।'
এভাবেই মহামারিতে বিপর্যয়ের শিকার এয়ারলাইন্স শিল্প চেষ্টা করছে মহামারির অবসানে। দ্রুত টিকা পৌঁছে দেওয়ার মূল সরবরাহ চক্রে তারাই হতে চলেছে প্রধান চালিকাশক্তি, যার মাধ্যমে পৃথিবীর সকল প্রান্তে টিকার শত শত কোটি ডোজও পৌঁছে দেওয়া যাবে।
তবে স্বাভাবিক অবস্থা হলেও এটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হতো। তার উপর আবার পরিবহন সংস্থাগুলো মহামারির কারণে কর্মী সংখ্যা কমিয়েছে। সীমিত করেছে রুট ও বিমানের সংখ্যাও। মহামারিতে বৈশ্বিক আকাশপথে যাত্রীসংখ্যায় নামা নজিরবিহীন ধ্বস মোকাবিলা করে লোকসান কম রাখতেই এমন পদক্ষেপ নেয়।
চলতি বছর আকাশপথে পরিবহন প্রায় ৬১ শতাংশ কমতে পারে, এমন অনুমানও করা হচ্ছে।
তাই বহুবিধ সমস্যা মাথায় নিয়েই করতে হচ্ছে টিকা পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা।
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)- এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালেক্সান্ডার ডি জুনিয়াক বলেন, ''রসদ পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এটাই হতে চলেছে সবচেয়ে বড় ও জটিল এক প্রচেষ্টা। ব্যর্থ হওয়ার অবকাশ নেই। কারণ, বিশ্ব আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে।''
আইএটিএ অনুমান করেছে ১১০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বোয়িং ৭৪৭ ফ্রেইটার বিমানের ৮ হাজার বার চলাচলের প্রয়োজন হবে। এভাবে পরিবহন করা গেলেও মানবজাতির সকল স্ত্রী-পুরুষ ও শিশুর জন্য ১৪শ' কোটি টিকার ডোজ পৌঁছে দেওয়ায় সময় লাগবে দুই বছর।
চাহিদাটি সত্যিই মহাকায়। বিশেষ করে যখন পরিবহন শিল্পের তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা সিরিয়াম জানাচ্ছে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ যাত্রীবাহী বিমানের বহর এখন ঠাঁই পেয়েছে সংরক্ষনাগারে। সেগুলোকে সচল করে পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোও সহজ কথা নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) টিকা বিভাগের প্রধান ক্যাথেরিন ও'ব্রায়ান দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে টিকা তৈরির পর তা বিতরণকে এক লাফে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
গত ১৬ নভেম্বর তিনি বলেন, 'চূড়ায় পৌঁছানো হচ্ছে সফলভাবে টিকা পৌঁছে দেওয়া।'
সকল মানুষ টিকা না পেলে দ্রুত উদ্ভাবনের চেষ্টা যে প্রকৃত সাফল্য পাবে না- সেদিকেই যেন ইঙ্গিত দেন তিনি।
তবে এই যে চেষ্টা, তার প্রধান কিছু বাধা-বিপত্তি এখানে তুলে ধরা হলো;
কার্গো ধারণক্ষমতা:
বিশ্বব্যাপী এখন সচল আছে মাত্র ২ হাজার সার্বক্ষণিক মালামাল পরিবাহী বিমান (ফ্রেইটার)। আকাশপথে যত মালামাল পরিবহন করা হয় এর অর্ধেক তারাই বহন করে। বাকি মালামাল ২২ হাজার যাত্রীবাহী জেট বিমানের পেটে থাকা কার্গো হোল্ডে বহন করা হয়।
চলতি বছর ফ্রেইটারগুলো খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটিয়েছে। কিন্তু, যাত্রীবাহী বিমানের হোল্ড শূন্য থাকায় কমেছে আকাশপথে মালামাল পরিবহন। অনেক এয়ারলাইন্স অবশ্য আড়াই হাজার যাত্রীবাহী বিমান শুধু কার্গো পরিবহনের কাজেই যুক্ত করেছে। তবে, এভাবে টিকা পরিবহন করা সহজ হবে না।
বিমানগুলো যদি তাদের প্রচলিত ভূমিকায় প্রচলিত গন্তব্যে চলাচল করতো, তাহলেই বরং কাজটি করা অপেক্ষাকৃত সহজ হতো। একারণেই, প্রথমদিকে তাদের মাল পরিবহনের ক্ষমতা সীমিত থাকবে।
আবার কার্গো ক্যারিয়ার উড়োজাহাজের চাহিদা যখন তুঙ্গে ঠিক সেই সময় শুরু হচ্ছে টিকা বিতরণের এ উদ্যোগ। সামনেই আবার বড়দিনের ছুটি। বছর শেষের ওই সময়ে সমগ্র খ্রিষ্টীয় বিশ্বে থাকে প্রিয়জনদের উপহার পাঠানোর চল। অনলাইন কেনাকাটার হিড়িকও দেখা যায়। আর চলতি বছর মহামারির কারণেই অনলাইন শপিং প্রায় শীর্ষস্থানে পৌঁছে গেছে।
প্রত্যাহার করা বিমান:
আফ্রিকার প্রায় অর্ধেক যাত্রীবাহী বিমান সংরক্ষণাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য মহাদেশের চিত্রও সুখকর নয়। নিচের তথ্যচিত্রে যা দৃশ্যমান।
আগামী বছরের শেষ নাগাদ ১৩০ কোটি ডোজ টিকা বিশ্বব্যাপী পাঠাতে চায় ফাইজার। গত সোমবার মডের্না ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ামক সংস্থার কাছে এর জরুরি প্রয়োগের স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে। তাদের বিতরণ লক্ষ্য ৫০ কোটি। আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার উৎপাদন সক্ষমতা ২শ' কোটি ডোজ। এর অর্ধেকই আবার পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে।
এপ্রসঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূরপাল্লার এয়ারলাইন্স এমিরেটসের ভাইস চেয়ারম্যান ডেনিস লিস্টার বলেন, ''বিশ্বকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে আমাদের যা করার অতিদ্রুত করতে হবে। তার অংশ হিসেবেই; টিকা দরকার এমন মানুষের কাছে বিমানে করে- তা পৌঁছেও দিতে হবে। সুষ্ঠুভাবে একাজ করা গেলে আবারও আমরা আকাশপথে যাত্রীদের ফিরে পাব।''
কিন্তু, টিকা পৌঁছে দিতে দরকার প্রত্যাহার করা বিমানগুলোকে ফের সার্ভিসে আনা। এজন্য সরকারগুলো যদি ভ্রমণ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলেই সেটা সহজ হবে- এমন দাবি করেন আইএটিএ'র বৈশ্বিক কার্গো পরিবহন বিভাগের প্রধান গ্লিন হিউজেস। অনেক আগে থেকেই অবশ্য এই শিল্প সংশ্লিষ্ট সকলে ভ্রমণ সচলের দাবি করে আসছেন।
ডিপ ফ্রিজ:
ফাইজার-বায়োএনটেক এসই'র ভ্যাকসিন সরবরাহ করা সমস্যার আরেক স্তর যোগ করেছে শুধু। এটি সংরক্ষণ করতে হবে মাইনাস ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায়, যা মেরু অঞ্চলে শীতকালের চেয়েও হিমশীতল। একারণে কোম্পানি দুটি জিপিএস নিয়ন্ত্রিত তাপ পরিমাপক যুক্ত করবে তাদের প্রতিটি টিকার চালানে।
নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার পরই আবার তা সঙ্গে সঙ্গে অতি-ঠাণ্ডা হিমাগারে রাখতে হবে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় একবার জমাট অবস্থা ভেঙ্গে গেলে টিকার ভাইলগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।
খুব সতর্কতার সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি ছন্দে চলতে হবে টিকাটি পৌঁছে দেওয়ার কাজ। কারখানা থেকে চিকিৎসা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতি পয়েন্টে থাকতে হবে সহায়ক হিম চক্রের উপস্থিতি।
এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য অবশ্য বিশেষ কন্টেইনার সরবরাহ করবে ফাইজার। কিন্তু, নতুন ধরনের তাপ নিরোধক কণ্টেইনার ওঠানামার ক্ষেত্রে এয়ারলাইন্স কর্মীদেরকেও প্রশিক্ষিত করার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।
ইতোপূর্বে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সূত্রে জানা গেছে, ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স ফাইজারের টিকা পরিবহনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ফাইজার ও ইউনাইটেড এই সংবাদের ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ