সড়ক-রেল উন্নয়নে যাত্রী হারাচ্ছে অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইনগুলো
দেশের সড়ক ও রেলপথে ভ্রমণ আগের তুলনায় উন্নত ও দ্রুতগতির হওয়ায় আকাশপথে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণকারীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এতে যাত্রী হ্রাস পাওয়ায় ক্রমাগত নিম্নমুখী আয় ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে স্থানীয় বিমান পরিবহন সংস্থাগুলো।
পাশাপাশি এ বছরের মার্চ থেকে নয় শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির উচ্চমূল্য এবং সরকারি শুল্ক বৃদ্ধির দরুন টিকিটের দাম বাড়ায় অনেক পরিবার আকাশপথে ভ্রমণ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান, ইউএস-বাংলা, ও নভোএয়ার। এয়ারলাইন কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, এসব সংস্থার প্রধান অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে যাত্রী সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার ফলে কমছে ফ্লাইট পরিচালনার সংখ্যাও।
গত বছর পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ায় যশোর ও বরিশাল বিমান রুটে যাত্রী পরিবহন উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করলে তার প্রভাব পড়তে শুরু করে বিমান সংস্থাগুলোর ওপর।
প্রিন্টএগ্রাফি নামক একটি মুদ্রণ ও প্রকাশনা সংস্থার সিইও এস. এম. আল মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যবসায়িক ও পারিবারিক কারণে প্রায় প্রতি মাসেই আমাকে যশোর যেতে হতো। আগে আকাশপথে তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগত; আর গাড়িতে ৭–৮ ঘণ্টা। তাই সময় বাঁচাতে আমি বিমানে যাতায়াত করতাম।
'কিন্তু পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ব্যক্তিগত গাড়িতে সর্বোচ্চ চার ঘণ্টা সময় লাগে। তাই এখন আর আমি বিমানে যাতায়াত করি না।'
আকাশপথের বদলে স্থলপথে ভ্রমণ বেছে নেওয়ার এ ধারা অন্যান্য রুটেও দেখা যেতে পারে। সম্প্রতি ঢাকা থেকে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন সার্ভিস চালু হওয়ার ফলে আকাশপথে ভ্রমণ বাদ দিতে পারেন আরও অনেক যাত্রীই। আবার অনেকেই টিকিটের উচ্চমূল্যের কারণে বিমানে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছেন।
ঢাকার বাসিন্দা একজন চাকুরিজীবী প্রতি বছর ডিসেম্বরে তার চার সদস্যের পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে আনন্দ ভ্রমণে যেতেন। তিনি জানান, সার্বিকভাবে সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে তিনি এ বছর তার ভ্রমণ বাতিল করছেন।
যাত্রী হ্রাস পাওয়ার বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের আরোপিত ভ্রমণ কর এবং জেট ফুয়েলের দামের অস্থিতিশীলতার কারণে গত ছয় মাসে তাদেরকে অভ্যন্তরীণ রুটে ন্যূনতম বিমানভাড়া প্রায় ১০ শতাংশ বাড়িয়ে সামঞ্জস্য করতে হয়েছে।
নভোএয়ার-এর এক সূত্র জানায়, 'সরকার প্রথমবারের মতো ২০০ টাকা ভ্রমণ কর আরোপ করায় আমাদের অভ্যন্তরীণ রুটে ন্যূনতম বিমানভাড়া ৩০০–৪০০ টাকা সমন্বয় করতে হবে। এছাড়া জেট ফুয়েলের দামও বাড়ছে।'
বিমানসূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এয়ারলাইনটি ঢাকা–বরিশাল রুটে এর সাপ্তাহিক সাতটি ফ্লাইট কমিয়ে মাত্র তিনটি ফ্লাইটে নিয়ে এসেছে।
নভোএয়ার যশোর রুটে আগে দৈনিক ৫–৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করত। সেতুটি উদ্বোধনের পর বিমানসংস্থাটি এখন মাত্র দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া যাত্রী কম থাকার কারণে এটি গত বছরের ১ আগস্ট থেকে বরিশাল রুটের উড্ডয়নও বন্ধ করে দিয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সও এর যশোর রুটের ফ্লাইটসংখ্যা কমিয়েছে। আগে দৈনিক ছয়টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুটিতে। ঢাকা–বরিশাল রুটে তাদের দৈনিক দুটি ফ্লাইটও স্থগিত করা হয়েছে।
নভোএয়ার-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করে জানান, ট্রেন পরিষেবা চালু হওয়ার পর কক্সবাজার রুটে যাত্রী সংখ্যা অর্ধেক পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বিমান পরিবহন খাতে এ মন্দায় আসন্ন ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতারও প্রভাব রয়েছে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স-এর জেনারেল ম্যানেজার (পিআর ও মার্কেটিং সাপোর্ট) কামরুল ইসলাম বলেন, 'পিক সিজন সত্ত্বেও চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অভ্যন্তরীণ রুটে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ যাত্রী কম হচ্ছে।'
যাত্রীতথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় ঢাকা বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ যাত্রী অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের জন্য বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেন।
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে দিগন্তপানে
স্থানীয় এয়ারলাইনগুলো এখন অভ্যন্তরীণ আয়ের স্থবিরতা কাটাতে আন্তর্জাতিক রুটের দিকে নজর দিচ্ছে।
কোভিড-১৯ মহামারি এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার বিস্তারের সাথে সাথে বৈশ্বিক এবং স্থানীয় বিমানভ্রমণ হ্রাস পেয়েছে। তবে করোনা বিধিনিষেধ শিথিল করার পর আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন খাত আবার চাঙা হয়ে উঠেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে, দেশের বিমানবন্দরগুলোয় ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক যাত্রী সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছ। এ সংখ্যা গত বছর ৯০ লাখ ৬৩ হাজারে পৌঁছায় যা ২০২১ সালে ৩৮ লাখ ৮৩ হাজার ছিল।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দেশের বিমানবন্দরগুলো ৭২ লাখের বেশি আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিচালনা করেছে, যা পরবর্তী মাসগুলোতে যাত্রীসংখ্যার অব্যাহত বৃদ্ধিকেই নির্দেশ করে।
এছাড়া রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক দেশের বাইরে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক যাত্রী সংখ্যায় তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড ১২ লাখ মানুষ চাকরির জন্য বিদেশে গেছেন।
যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারায় সাড়া দিয়ে বেসরকারি পরিবহনসংস্থাগুলোও মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশীয় রুটগুলোতে তাদের বহর দ্রুত প্রসারিত করছে।
পরিধি বাড়াচ্ছে বিমান
পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়ায় বিমান এর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়। বিমানের বিপণন ও বিক্রয় পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'রাজনৈতিক কারণে আমরা অভ্যন্তরীণ রুটে চাহিদার ১০ শতাংশ যাত্রী কম পাচ্ছি। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রুটে ফ্লাইট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।'
বিমান সিলেট-জেদ্দা-সিলেট, সিলেট-মদিনা, মদিনা-চট্টগ্রাম, দুবাই-চট্টগ্রাম, সিলেট-আবুধাবি, চট্টগ্রাম-আবুধাবি এবং চট্টগ্রাম-দোহাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়িয়েছে। প্রবাসী এবং দেশে ফেরত আসা হজযাত্রীদের কথা মাথায় রেখে এ নতুন পরিষেবাগুলোয় চালু করা হয়েছে।
ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া পর্যটকদের লক্ষ্য করে বিমান আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে দক্ষিণ ভারতের চেন্নাইয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমানে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাড়াচ্ছে ইউএস-বাংলা
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স-এর জেনারেল ম্যানেজার (পিআর ও মার্কেটিং সাপোর্ট) কামরুল ইসলাম বলেন, মাওয়া–ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ও পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই বরিশাল ও যশোর রুটে যাত্রী কমতে শুরু করেছে।
তবে তিনি আশাবাদী, ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন চালু হলেও বিমানভ্রমণে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না, কারণ ট্রেন যাত্রায় সময় লাগে ৮–১০ ঘণ্টা।
অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের পতন কমাতে ইউএস-বাংলা আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও বাড়াচ্ছে। এটি এ বছরের ১ ডিসেম্বর ঢাকা ও ব্যাংককের মধ্যে দৈনিক ফ্লাইট শুরু করে, যা এর আগে সপ্তাহে পাঁচ দিন পরিচালিত হতো।
কামরুল বলেন, 'আমরা আগামী বছরের মধ্যে ঢাকা–জেদ্দা এবং ঢাকা–রিয়াদ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা করছি। আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বাড়ানোর অংশ হিসেবে দুটো এয়ারবাস এ৩৩০ ক্রয় প্রক্রিয়াধীন আছে।'
ইউএস-বাংলার বহরে বর্তমানে ২০টি বিমান রয়েছে যার মধ্যে ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৯টি এটিআর ৭২-৬০০, এবং ৩টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০। সংস্থাটি ১১টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে পরিবহনসেবা দিচ্ছে।
নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণের ইচ্ছা নভোএয়ার-এর
'কক্সবাজার-সিলেটসহ পর্যটকপ্রবণ রুটগুলোতে এ সিজনে আগে আসন শতভাগ বুক থাকত। কিন্তু এবার রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে নভেম্বর মাসে ২০ শতাংশ যাত্রী কম পাচ্ছে নভোএয়ার,' বলেন বেসরবারি বিমান পরিবহন সংস্থাটির হেড অভ মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস মেসবাহ-উল ইসলাম।
এ কারণে নভোএয়ার নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক রুটে সম্প্রসারণের দিকে নজর দিচ্ছে। অনুকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে নতুন রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির।
এজন্য এয়ারলাইনটি অন্তত তিনটি নতুন বিমান কেনার জন্য এয়ারবাস-এর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।
বর্তমানে নভোএয়ার কেবল ঢাকা–কলকাতা রুটে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করে।
'আমরা নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছি। পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলে আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসের দিকে ধাপে ধাপে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, দুবাই, ও দোহায় ফ্লাইট চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে,' বলেন নভোএয়ার-এর একজন কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, 'অভ্যন্তরীণ যাত্রীর চাপ কম থাকায় এয়ারবাস ছাড়াও আমাদের বহরের বিদ্যমান ৭টি এটিআর বিমানও আন্তর্জাতিক রুটে ব্যবহার করা হবে।'
বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক যাত্রার পরিকল্পনা এয়ার অ্যাস্ট্রা'র
এয়ার অ্যাস্ট্রা'র ডেপুটি ম্যানেজার (জনসংযোগ) সাকিব হাসান শোভো টিবিএসকে বলেন, 'নভেম্বরে আমাদের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বুকিং ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। যদিও এ মাসে অবস্থা কিছুটা বদলেছে, তবে তা এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত ১৫ শতাংশ কম।'
এয়ার অ্যাস্ট্রা'র তিনটি এটিআর বিমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক রুটে বহর সম্প্রসারণের কথা মাথায় রেখে আরও দুটি এটিআর যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে এটির। ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে সংস্থাটি।
'আমরা আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুমতি পাব বলে আশা করছি। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছরের এপ্রিল–মে মাসে ভারতে আমাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হতে পারে,' সাকিব জানান।