কংগ্রেসের সুদিন ফেরানোর অঙ্গীকার প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর
ভারতীয় রাজনীতিতে বর্তমানে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি। লম্বা সময় ধরে নেহেরু-গান্ধী পরিবারের হাতেই থেকেছে ঐতিহ্যবাহী এই দলটির ক্ষমতার নাটাই।
সেই নেহেরু-গান্ধী পরিবারেরই উত্তরাধিকারী ইন্দিরা গান্ধী ভদ্র এক সাম্প্রতিক নির্বাচনী শোভাযাত্রার মঞ্চে দাঁড়িয়ে জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন : "আমি একজন নারী, আমিও লড়তে পারি।" সমবেত জনতাকে তার সঙ্গে এই স্লোগানের পুনরাবৃত্তি করতেও বলেন তিনি।
এই স্লোগানের উপর ভর করেই ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে আগামী বছর নির্বাচনে জয়ের স্বপ্ন দেখছে দলটি। তাদের আশা, এতদিন প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা নারীরা যেহেতু বর্তমানে নিজেদের অধিকার আদায়ে সরব হচ্ছে, তাই তারাই হয়ে উঠতে পারে নির্বাচনে জয়ে কংগ্রেস পার্টির তুরুপের তাস।
উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের ফল থেকেই হয়তো খানিকটা আঁচ পাওয়া যাবে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী কংগ্রেস ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবে কি না।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং একটি শক্তিশালী, আধুনিক ভারতের স্বপ্ন দেখিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন মোদী, এবং ২০১৯ সালেও তিনি অনায়াসে পুনঃনির্বাচিত হন।
মোদীর উত্থান ঘটেছে এমন একটি সময়ে, যখন নেতৃত্বজনিত দ্বন্দ্ব-বিবাদে ধুঁকছিল ১৩৬ বছর বয়সী কংগ্রেস। প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ভাই, রাহুল গান্ধীও ব্যর্থ হয়েছেন ভোটারদের মন জয় করতে। তাই ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সাধারণ নির্বাচনে হারার পর তিনি কংগ্রেস প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
বর্তমানে দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন তাদের মা, অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি সোনিয়া গান্ধী। অনেকেরই অভিযোগ, দলটি বর্তমানে খুবই সেকেলে মানসিকতার অধিকারী, এবং গান্ধী পরিবারের উপর খুব বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল।
ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে পুঁজি করে কংগ্রেস নিজেদের দাবি করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় দল হিসেবে, এবং ২০১৯ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ করা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রের নেতৃত্বে আগামী নির্বাচনে তারা আশা করবে নারীদের ভোট টানার। একই সঙ্গে নিজেদের মোদীর নেতৃত্বাধীন বর্তমান কট্টরপন্থী হিন্দু সরকারেরও বিকল্প হিসেবেও প্রতিষ্ঠার আশা করছে তারা।
নারীদের উপর সহিংসতা সমগ্র ভারত জুড়েই একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত উত্তর প্রদেশের অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গিন। সরকারি তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি লিঙ্গ অপরাধ এখানেই ঘটে থাকে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আশ্বাস দিয়েছেন নারীদের বর্তমান অবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসার।
"আমি নারীদের বলতে চাই যে আমি তাদের জন্য লড়াই করব, কংগ্রেস পার্টি তাদের জন্য লড়াই করবে," গত রোববার বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতা ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ঘাঁটি গোরাখপুরে গিয়ে এ কথা বলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। এ কথার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিপুল হর্ষধ্বনিও লাভ করেন তিনি।
উত্তর প্রদেশে বিজেপি দলীয়ভাবে বেশ সংগঠিত। তারপরও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও কোভিড-১৯ মহামারি ঠিকভাবে সামলাতে না পারার সমালোচনা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মোদীর উদারীকরণের বিরুদ্ধে রাজ্যটি কৃষকদের বিক্ষোভেরও সম্মুখীন হচ্ছে।
গোরাখপুরের রাজনৈতিক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী নারীদের অনুপাত ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। মোট অংশগ্রহণকারী ৪০ হাজার মানুষের এক-চতুর্থাংশই ছিল নারী, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসের নারীভিত্তিক এজেন্ডা সফলতার দিকেই এগোচ্ছে।
"জনগণ, বিশেষত নারীরা, আশা নিয়ে কংগ্রেসের দিকে তাকাচ্ছে। তারা আশা করছে, এই দলটি নারীদের পক্ষে দাঁড়াবে, তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠবে," বলেন ৪০ বছর বয়সী সুনীতা মিশ্র নামের শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া একজন দলীয় কর্মী।
এই রাজ্য থেকে যে ৪০৩টি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশে নারীদের মনোনয়ন দেওয়ার আহবান জানিয়েছে কংগ্রেস। বিষয়টিকে ভোটাররা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করেছে, এবং গত কয়েকদিনে ৫০ জন নারীদের দলীয় ক্যাডার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে তাকে সাহায্য করেছে বলে জানান মিশ্র।
এছাড়া দলটি নারীদের নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইলেকট্রিক স্কুটার ও স্মার্টফোন, সকল নারীর জন্য সরকারী বাসে ফ্রি রাইড, বছরে প্রতি পরিবারের জন্য তিনটি ফ্রি কুকিং-গ্যাস সিলিন্ডার এবং লিঙ্গভিত্তিক চাকরি সংরক্ষণেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তবে এসবের পরও, উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস বেশ কিছু অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে।
"রাজ্যের নেতৃস্থানীয়রা কেবল ধান্দাবাজদের কথাই শুনছেন, এবং গত দুই বছরে দলে এমন লোকের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে," বলেন গোরাখপুর থেকে কংগ্রেসের সাবেক নির্বাচনী প্রার্থী রানা রাহুল সিং, যিনি সম্প্রতি দলত্যাগ করেছেন।
"কংগ্রেসের তৃণমূল কর্মীরা অবহেলিত হচ্ছেন।"
প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর দলের কেউ রয়টার্সের কাছে সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হননি। তবে দলটির মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনাতে জানান, দলটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে।
"পরিবর্তন অস্বস্তিকর, কিন্তু তবু পরিবর্তন ভালো," শ্রীনাতে বলেন। "দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে এসব পরিবর্তন কাজে আসবে।"
পোলিং এজেন্সি সিভোটারের করা এক সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্য নির্বাচনে ৪০৩টি আসনের মধ্যে ২৪০টি দখল করে খুব সহজেই জিতে যাবে বিজেপি। কংগ্রেস হয়তো স্রেফ তিনটি থেকে সাতটি আসনে জিতে চতুর্থ অবস্থানে থাকবে।
২০১৭ সালের সর্বশেষ রাজ্য নির্বাচনে কংগ্রেস জোট বেঁধে লড়াই করে, এবং ১১৪টি আসনের মধ্যে তারা মাত্র সাতটিতে জয়লাভ করে। বিপরীতে বিজেপি জয়লাভ করে ৩১২টি আসনে।
তবে সামগ্রিকভাবে ভারতজুড়ে নারী ভোটারদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং অনেক রাজ্যেই এখন পুরুষ ভোটারের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। এই তথ্য দিয়েছেন নয়া দিল্লির সেন্টার ফর দ্য স্টাডিজ অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের প্রবীণ রাই।
"এতে করে আমরা আরও বেশি আসন পাব কি না, তা অনুমান করা কঠিন," কংগ্রেসের নারী-ফোকাস কতটুকু কার্যকর হবে সে প্রশ্নের জবাবে রাই বলেন। "কিন্তু আমি মনে করি এটিই সঠিক কৌশল দলের জন্য একটি প্রত্যাবর্তন ঘটানোর, এবং নিজেদের জন্য একটি রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করার।"
গোরাখপুরের শোভাযাত্রায় কংগ্রেসের জেলা সভাপতি নির্মলা পাসওয়ান বলেন, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর উপর তার আশা আছে।
"অনেক নারীই আমাদের কাছে আসছেন দলে যোগ দিতে," তিনি বলেন। "পরিবর্তন সত্যিই আসছে, এবং নারীরাই এটি নিয়ে আসছেন।"
- সূত্র: রয়টার্স