কাবুলের গোপন ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার আগে সব সরঞ্জাম পুড়িয়ে ফেলে সিআইএ
আফগানিস্তানে পশ্চিমা বাহিনীর অভিযানের গোপন অংশ হিসেবে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কাবুলে গড়ে তুলেছিল এক গোপন ঘাঁটি। ৩১ আগস্টের মাঝে সেনা প্রত্যাহারের তাড়াহুড়ায় সেই ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে সব সরঞ্জাম পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে এসেছেন তারা।
তালেবান নেতারা সিআইএ'র ব্যবহৃত পুড়ে যাওয়া সেসব কার, মিনিবাস ও সাঁজোয়া গাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ দেখে যেতে গণমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কাবুলের সেই ঘাঁটিতে।
তাদের মতে, এই গোপন ঘাঁটিতে বন্দিদের ওপর চালানো হতো হত্যা অভিযান ও নির্যাতন।
ঘাঁটি অবস্থিত সেই আফগান গ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত আধা সামরিক বাহিনীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। একটি উঁচু ভঙুর দেওয়ালের পাশে মিলেছে সিআইএ'র ব্যবহৃত সারি সারি পোড়া গাড়ি।
তালেবানের দাবি, সিআইএ'র এই ঘাঁটি ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বন্দুক থেকে গ্রেনেড, মর্টার থেকে ভারি আর্টিলারি- যেসব তারা মানুষ হত্যার কাছে ব্যবহার করত সব জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন সারি শিপিং কন্টেইনার, মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করার সেল- সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়ে যায় তারা।
এগুলো ধ্বংসের সময় বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়, যা কাবুল বিমানবন্দরে রক্তাক্ত বোমা হামলার পরপরই ঘটানো হয়। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠেছিল রাজধানী কাবুল।
গত দুই দশকের আফগান যুদ্ধে এই ঘাঁটি এবং এখানে চলা সকল কর্মকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকারে।
বিমানবন্দরের উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইল এলাকাজুড়ে, ঘাঁটিটির পাশেই একটি কারাগার নির্যাতন ও হত্যার জন্য হয়ে উঠেছিল কুখ্যাত। সিআইএ'র কাছে কারাগারটি 'কোবাল্ট' বা 'সল্ট পিট' কোডনামে পরিচিত ছিল। তবে সেখানে থাকা বন্দিরা এটিকে 'ডার্ক প্রিজন' বলে ডাকত, যার অর্থ 'অন্ধকার কারাগার'। বন্দিদের এমন নাম দেওয়ার কারণ, এই কারাগারে কখনো আলো জ্বালানো হতো না। দিন কিংবা রাত- বন্দিদের সব সময়ই থাকতে হতো অন্ধকারে।
২০০২ সালে এই কারাগারেই গুল রহমান নামে একজন মারা যান হাইপোথার্মিয়ায়। কারণ প্রচণ্ড শীতের এক রাতে তাকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় দেওয়ালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পরই সিআইএ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রথম কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা জারি করেছিল। কারণ, ২০১৪ সালে এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করা সিআইএ'র জন্য মোটেও বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হয়নি।
ঘাঁটিটি ২০ বছর ধরে পুরো বিশ্বের কাছ থেকে প্রায় সম্পূর্ণ গোপন ছিল; কেবল স্যাটেলাইট ছবি এবং এখান থেকে জীবিত ফেরা মানুষদের মাধ্যমেই এটিকে ট্র্যাক করা সম্ভব ছিল। তবে সম্প্রতি তালেবানরা ঘাঁটির কিছু অংশ খুলে দিয়েছে সাংবাদিকদের জন্য।
তালেবান নেতা মুহাম্মাদ হাসনাইন বলেন, 'আমরা দেখাতে চাই তারা কীভাবে এইসব জিনিস নষ্ট করেছে, যা আমাদের দেশ গড়তে ব্যবহার করা যেত।'
এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, যুদ্ধে উভয় দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের আশায় অভাগা আফগানরা কীভাবে উভয় পক্ষের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
হাসনাইন জানিয়েছেন, সাবেক এই সিআইএ ঘাঁটি এখন তারা নিজেদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবেন।
এখানে 'সল্ট পিট' কারাগারের পাশে যে আধা সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, সেটি আফগানিস্তানের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর বাহিনীগুলোর একটি। তাদের বিরুদ্ধে অনেক বেসামরিক মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন, এমনকি শিশু নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে।
সাংবাদিকরা যখন পৌঁছান, তখন সেখানে কারও কারও অর্ধেক শেষ করা খাবারও পেয়েছেন। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল আলমারির জিনিসপত্র। এ থেকেই বোঝা যায়, খুব অল্প সময়ের মাঝেই ব্যারাকগুলো খালি করা হয়েছিল।
হাসানাইন জানান, তারা ক্যাম্পের ধ্বংসস্তূপে বেশ কয়েকটি ফাঁদ বোমা খুঁজে পেয়েছেন এবং আরও পাওয়া যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান