'কোভিডমুক্ত' তুর্কমেনিস্তান: সরকারের দাবি অস্বীকার মানবাধিকার কর্মীদের
মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই বছরে তুর্কমেনিস্তানে একটিও কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়নি। এমনটাই দাবি করছে মধ্য এশিয়ার এই দেশটির কর্তৃত্ববাদী সরকার।
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, ৬ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের দেশ তুর্কমেনিস্তান, বিশ্বের পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে এখনো পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোনো ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি। এর মধ্যে তিনটি দেশ প্রশান্ত মহাসাগরের বিচ্ছিন্ন তিনটি দ্বীপ এবং চতুর্থ দেশটি হলো উত্তর কোরিয়া, যেখানে বাকস্বাধীনতাকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
তুর্কমেনিস্তানের স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি গুরবাঙ্গুলি বারদিমুখামেদভ, দেশের করোনাভাইরাস সংক্রমণের সকল প্রতিবেদন এবং খবরকে 'ভুয়া' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলবার এক ভাষণে তিনি জাতিসংঘকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, মহামারির প্রতিক্রিয়া নিয়ে 'রাজনীতি' করা উচিত নয়।
কিন্তু তুর্কমেনিস্তানের বাইরে বিভিন্ন স্বাধীন সংগঠন এবং সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশটি বর্তমানে মহামারির তৃতীয় ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করছে। অসংখ্য মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে; কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এবং সেই সঙ্গে তারা সতর্ক করেছে, রাষ্ট্রপতি জনসাধারণের সামনে তার 'ইমেজ' ধরে রাখতেই মারাত্মক এই ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে খেলছেন!
তুর্কমেনিস্তান থেকে নির্বাসিত রুশলান তুর্কমেন, নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক স্বাধীন সংবাদ সংস্থা তুর্কমেন নিউজের একজন সম্পাদক। তিনি দাবি করেন, দেশের অভ্যন্তরে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ৬০ জনেরও বেশি লোকের নাম সংগ্রহ করেছেন, যারা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
তুর্কমেন বলেন, মৃতদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নথিপত্র ও এক্স-রে রিপোর্ট যাচাই করে তিনি দেখেছেন, তাদের প্রত্যেকের ফুসফুস গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং তাদের দেওয়া চিকিৎসা সেবার সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবার যথেষ্ট মিল রয়েছে।
তুর্কমেন বলেন, "মহামারিকে সাধারণভাবে গ্রহণ করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার পরিবর্তে, তুর্কমেনিস্তান বালিতে মাথা গুঁজে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।"
এ ব্যাপারে তুর্কমেনিস্তান সরকারের মন্তব্য জানতে চাইলে, সরকার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
২০২০ এর শুরুতে বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও, তুর্কমেনিস্তান জোর দিয়েই বলেছিল, সে দেশে করোনাভাইরাসের কোনো আলামত নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, সাড়ে ৫ মিলিয়ন কোভিড সংক্রমণ নিয়ে ইরান বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তর কোভিড-১৯ আক্রান্ত দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। অথচ, ইরানের সঙ্গে একটি দীর্ঘ স্থলসীমা থাকা সত্ত্বেও, তুর্কমেনিস্তানে কোভিড সংক্রামণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
তুর্কমেন বলেন, ২০২০ সালের মে মাসে যখন সারা বিশ্বে কোভিডের প্রাদুর্ভাব ছড়াতে থাকে, তখন তুর্কমেনিস্তানে তার সূত্র থেকে তিনি খবর পেয়েছিলেন, দেশের অনেক মানুষ 'অদ্ভুত এক ফুসফুস রোগে' আক্রান্ত হচ্ছে। রোগটি অনেকটা ফ্লুয়ের মতো।
২০২০ সালের জুন মাসে, রাজধানী আশখাবাতের মার্কিন দূতাবাস, স্থানীয় নাগরিকদের কোভিড-১৯ এর লক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে এক সতর্কবার্তা জারি করে, ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনের পরামর্শ দিয়েছিল।
কিন্তু তুর্কমেনিস্তান সরকার এটিকে সঙ্গে সঙ্গেই 'ভুয়া' সংবাদ বলে প্রচার করেছিল।
২০২০ সালের জুলাইয়ে, তুর্কমেনিস্তানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি মিশন দেশের অভ্যন্তরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে না পারলেও, সেখানে 'শ্বাসতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ এবং নিউমোনিয়া রোগের সংখ্যা বৃদ্ধির' বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।
ডব্লিউএইচও'র এক কর্মকর্তা বলেন, "তুর্কমেনিস্তানকে এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ছে।"
কিন্তু তুর্কমেনের মতে, ততদিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
এই বছরের জানুয়ারিতে, তুর্কমেনিস্তানে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের জুনে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেশটির স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন এবং কোভিড-১৯ এর হুমকি মোকাবেলায় সরকারকে ২০ মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়েছে.
মঙ্গলবারের ভাষণে প্রেসিডেন্ট বারদিমুখামেদভ কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের প্রচেষ্টাকে 'অপর্যাপ্ত' হিসেবে উল্লেখ করলেও নিজের দেশের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
তিনি বলেন, "এই মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় মারাত্মকভাবে পদ্ধতিগত ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে"।
ইউরোপভিত্তিক নির্বাসিত গোষ্ঠী রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস অব তুর্কমেনিস্তান সিটিজেনস-এর পরিচালক ডায়ানা সেরেব্রায়নিক বলেন, তার সংগঠন দেশের পরিচিতদের কাছ থেকে শুনেছে, সেখানকার হাসপাতালগুলো বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে।
সেরেব্রায়নিকের দেওয়া তথ্যানুসারে, মেডিকেল সার্টিফিকেটে মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক কারণ হিসেবে কোভিড-১৯ বা নিউমোনিয়াকে তালিকাভুক্তির পরিবর্তে হার্ট অ্যাটাক বা অন্য কোনো রোগের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে একাধিক কর্তৃত্ববাদী সরকার দেশের অভ্যন্তরে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কথা স্বীকার করেছেন। এমনকি প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত দেশ হিসেবে চীন আন্তর্জাতিক সহায়তাও পেয়েছে।
তাহলে তুর্কমেনিস্তান কেন এত জোর দিয়ে বলছে, সেখানে কোভিড সংক্রমণের কোনো ঘটনা দেখা যায়নি?
সেরেব্রায়নিক বলেন, প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারদিমুখামেদভ কোভিড-১৯ কে অস্বীকার করে দেশের একজন ত্রাণকর্তা এবং একজন প্রভাবশালী বিশ্বনেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
দেশে মারাত্মক এই ভাইরাসের উপস্থিতি স্বীকার করলে প্রেসিডেন্টের আদর্শিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে এবং তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হওয়াসহ সম্ভাব্য জবাবদিহিতারও সম্মুখীন হতে পারেন; ফলে দেশের মহামারির পুরো ঘটনাটিকেই তিনি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেনবার বলেন, ডব্লিউএইচও সহ তুর্কমেনিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দায়িত্ব ছিল দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরো বিশ্বের সামনে সত্য উপস্থাপন করা।
ডেনবার বলেন, বৈশ্বিক মহামারির প্রাদুর্ভাব আন্তর্জাতিক সীমান্তের সঙ্গে সংযুক্ত; সুতরাং দেশগুলোর উচিত সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং জনসাধারণের মাঝে সঠিক তথ্য সরবরাহ করা। তিনি আরও বলেন, "আমরা সবাই পরস্পর সংযুক্ত; যখন আমাদের মধ্যে কেউ ব্যর্থ হয়, আমরা সবাই ব্যর্থ হই।"
- সূত্র- সিএনএন