চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধে ভাগ হয়ে যেতে পারে নেট জগত!
পৃথিবীর শীর্ষ দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীন জড়িয়ে পড়েছে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে। আগামীদিনে তা শুধু আরও তীব্রতা লাভ করবে, এমন কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই বিরোধ ইতোমধ্যেই তথ্য-প্রযুক্তি খাতে প্রভাব ফেলছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সরবরাহ চক্র ভিন্নতার কারণে সামগ্রিক ইন্টারনেট জগতটাই বিভাজিত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরেই তথাকথিত স্প্লিন্টারনেট বা খণ্ডিত নেট জগতের আলোচনা উঠে আসছে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়। স্প্লিন্টারনেট হলো এমন ব্যবস্থা; যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভার্চুয়াল বিচরণের দুনিয়ার এক অংশ নিয়ন্ত্রণ করবে এবং অপর অংশের নেতৃত্ব দেবে চীন।
প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাত্রই জানেন, চীনের আছে নিজস্ব ফায়ারওয়াল ব্যবস্থা। দেশটির নাগরিকরা কোন ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করতে পারবেন এবং তা রাজনৈতিক ঝুঁকি মুক্ত কিনা- তা সরকারই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তারপরও, বর্তমান অবস্থায় এটি আন্তর্জাতিক তথ্যজগতের সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত। কিন্তু, গভীর বিভাজন দেখা দিলে বৈশ্বিক ব্যবহারকারীদের যেকোনো একটি সেবা বেছে নেওয়ার পথে হাটতে হবে।
এখানে তথ্য ভান্ডার মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে বলে জানিয়েছেন সিএনবিসি'র 'বিয়ন্ড দ্য ভ্যালি' পডকাস্টে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা।
বাণিজ্যের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে গবেষণাকারী সংস্থা ইউরেশিয়া গ্রুপ। সংস্থার বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রয়োগ অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রধান পল ট্রিও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
''আমরা যদি স্প্লিন্টারনেটের মতো পৃথক দুই সাইবার দুনিয়ার কথা বলি, তাহলে কতদূর পর্যন্ত তা বিভাজিত হবে- নির্ধারন করবে দুইটি বিষয়। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি তথ্য ভাণ্ডার এবং তা পরিচালনার নীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে,'' ট্রিও বলছিলেন।
কিছু মাত্রায় বৈশ্বিক সাইবার মাধ্যমের বিচ্ছিন্নতা এখনই চোখে পড়ে। যেমন, দীর্ঘদিন ধরে গুগুল, ফেসবুকের মতো মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে ব্লক করে রাখে বেইজিং। অ্যাপ ব্যবহারেও আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। চীনের তৈরি কিছু অ্যাপ শুধু স্থানীয় গ্রাহকদের ব্যবহার উপযোগী। পশ্চিমের অধিকাংশ নাগরিক এগুলোর লে-আউট এবং ইউজার ইন্টারফেস সম্পর্কে জানেন না।
যুক্তরাষ্ট্র এবং বাকি বিশ্বে যেমন ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন, ঠিক তেমনি চীনের আছে আলীবাবা গ্রুপের মালিনাধীন তাওবাও বা জেডি ডটকম। দেশটিতে শত কোটির বেশি কাছাকাছি জনগণের প্রিয় চ্যাটিং মাধ্যম হলো; হোয়াটসঅ্যাপ। পাশপাশি রাজনৈতিক ঝুঁকি বিবেচনায় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে কন্টেন্ট সেন্সর করতে বাধ্য করে বেইজিং।
অবশ্য, এই স্বতন্ত্রতা একটি স্তর মাত্র। ভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করেও বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থায় যুক্ত হতে পারেন ব্যবহারকারীরা। স্প্লিন্টারনেট বলতে এমন অবস্থার ধারণা দেওয়া হচ্ছে, যেখানে বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের নিষেধাজ্ঞার ভয়ে একে-অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারবে না। করতে পারবে না তথ্য আদান-প্রদান। আর শেষোক্তটাই হয়ে উঠবে স্প্লিন্টারনেটের মূল উৎস।
তথ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ বিকাশের অনেক দিক জড়িত। একারণে, ডাটা গভরন্যান্স বা পরিচালনা নীতি নিয়ে সম্পর্কে টানা-পোড়েন সৃষ্টি হয় নানা দেশের মধ্যে। শুধু চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা হয়নি। কিছুদিন আগেও ঘনিষ্ঠ মিত্র হওয়ার পরও ভারতের সঙ্গে তথ্যের স্থানীয়করণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিরোধ নতুন মাত্রা লাভ করেছিল।
তথ্য পরিচালনায় ভিন্নতা:
বেইজিং যেভাবে তথ্য নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষন করে তার কারণেই চীনা কোম্পানিগুলোকে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্যও এভাবে কাজে লাগিয়ে তা গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করবে চীন।
এমন অভিযোগ তুলেই গত ৬ আগস্ট এক বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করে, যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও প্লাটফর্মটি 'মার্কিন নাগরিকদের বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে' উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, এসব তথ্য চীন সরকারের হাতে চলে যেতে পারে।
বেইজিং-ভিত্তিক কোম্পানি বাইটড্যান্স টিকটকের মালিকানা প্রতিষ্ঠান। মার্কিন সরকারের আনীত সকল অভিযোগ কোম্পানিটি অস্বীকার করেছে। তারপরও ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের মুখে ওরাকলের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে কোম্পানিটি। এখন থেকে টিকটকের মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য ওরাকল নিয়ন্ত্রণ করবে। চুক্তিটি এখনও সম্পূর্ণ হয়নি এবং বিস্তারিত রয়েছে অপ্রকাশিত।
এটি তথ্য স্থানীয়করণ প্রক্রিয়ার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। কোনো দেশের ব্যবহারকারীর তথ্য সেদেশেই সংরক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে হবে – এমন দাবি নানা দেশের সরকারের পক্ষ থেকেই করা হচ্ছে। চীনে ব্যবস্থাটি চালুও আছে।
তথ্যের বিভাজন শুধু ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা অবিশ্বাসের ফসল নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ স্থানীয়ভাবে করার যে নীতি নিয়েছে, সেটাও যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করে।
তথ্য লেনদেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ জোট 'প্রাইভেসি শিল্ড' নামক এক চুক্তির আওতায় কাজ করে। আটলান্টিকের দুই পাড়ে অবস্থিত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং তথ্য চলাচলের সুরক্ষা এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। এজন্য উভয়পক্ষ নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডের ভূখণ্ড ব্যবহার করে থাকে। হাজার হাজার ইউরোপীয় ও মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি চুক্তিটির আওতাধীন।
ইইউ জোটের শীর্ষ আদালত ইউরোপিয়ান কোর্ট অব জাস্টিস চলতি বছরের গোঁড়ার দিকেই এ চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জানায়, এর মাধ্যমে ইউরোপীয় নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিজ নাগরিকদের পর্যবেক্ষণে রাখতে তথ্য পরিচালনায় বেশকিছু নীতি মেনে চলে। এসব নীতির কারণেই চুক্তিটি বাতিল করার রায় দিয়েছে ইইউ আদালত।
- সূত্র: সিএনবিসি