জাহাজে কন্টেইনার পরিবহনে আগামী কয়েক বছর জুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখবে বিশ্ব
বিশ্বের কার্গো জাহাজ বহর একযোগে কাজ করতে পারছে না। মহামারির তাণ্ডবে পৃথিবীর পণ্য উৎপাদন গতি যখন থেকে থেকেই ব্যাহত, তারমধ্যে পরিবহনের এই জটিলতা হুমকিতে ফেলেছে বিশ্ব বাণিজ্যকেই।
সমস্যার গোঁড়া থেকে বলতে হলে, চলতি বছরে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ জোড়া বন্দর; লস অ্যাঞ্জেলস ও লং বিচে অপেক্ষমাণ জাহাজের দীর্ঘ সাড়ির কথা উল্লেখ করা যায়। এসময় আমদানি করা পণ্য নিয়ে খালাসের অপেক্ষায় ছিল ৪০টির বেশি জাহাজ। মে মাসে বন্দরটি রেকর্ড ১৯ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করে। এই সংখ্যাটি মার্চের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল।
অর্থাৎ, পণ্যের একমুখী প্রবণতা (আমদানি) যুক্তরাষ্ট্রে আসা পণ্যধারক বাক্সের (কন্টেইনার) সংখ্যা বাড়ায়।
তারপরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল; সুয়েজ খালে প্রায় এক সপ্তাহ কন্টেইনারবাহী সুবিশাল জাহাজ এভারগিভেনের আটকে পড়া। এই জটে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে যাত্রায় দেরি হয় শত শত অন্য জাহাজের। তার সঙ্গে এখন চীনের শেনঝেন নগরীর ইয়ানতিয়ান বন্দর এলাকায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধির ঘটনা সঙ্কটের ষোলকলা পূরণ করেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এলাকায় নতুন প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রায় এক মাস পিছিয়ে গেছে বাণিজ্যের সময়সূচি।
কেউ যদি মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতি মহামারির অভিঘাতগুলো কাটিয়ে ওঠা শুরু করলেই সমুদ্রপথে কন্টেইনারের মাধ্যমে বাণিজ্যও চিরচেনা রূপে ফিরে আসবে; তাহলে তিনি ভীষণ ভুল করছেন। কারণ, এশিয়া-ইউরোপ যাত্রাপথে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যের পণ্য ধারক বাক্সটির দর রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১০ হাজার ডলার ছাড়িয়েছে। তাই একে সমন্বয়ের অভাবে সৃষ্ট অস্থায়ী সমস্যা ধরে নেওয়া ঠিক নয়। বরং এই অবস্থা স্বাভাবিক হতে একাধিক বছর লাগতেও পারে।
আরেকটি বড় ব্যাপার হলো, জটিলতা তীব্র না হলে এমন আলোচনাই উঠতো না। কারণ, জাহাজে কন্টেইনার পরিবহন এত সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত বাণিজ্যিক শক্তি- যে এর বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে তেমন আলোচনার দরকার হয় না। স্বাভাবিক সময়ে এতদিন প্রায় নিরুদ্রুপে চলে এসেছে এ বাণিজ্য। অত্যাধুনিক কিছু কিছু বন্দরে তো সুর্যোদয়ের সময় ১০ হাজার কন্টেইনার নিয়ে ভেড়া জাহাজ মাল খালাস করে সুর্যাস্ত নাগাদ নতুন কন্টেইনার চালান নিয়ে বন্দর ছেড়ে চলেও যেতো। ফলশ্রুতিতে ছিল না কন্টেইনার সঙ্কট। উল্টো ২০১৬ সালের মতো কোনো কোনো বছর পণ্য ধারকটির ভাড়া এত কমেছিল যে, সাংহাই থেকে রটরড্যাম বন্দরে এক মেট্রিক টন পণ্য আনার খরচ প্রায় ১০ ডলারে নেমে আসে। কম দরে জাহাজে পণ্য পরিবাহী সংস্থার লোকসান হয়নি, বরং ওই সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং লাইন এপি মোলার-মায়েরস্ক সন্তোষজনক মুনাফা অর্জন করেছিল।
কিন্তু, এই চিত্রের নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে; বাণিজ্যে যখন একবার ভুলের সূত্রপাত হয়, তখন সব হিসাব বদলে যায়, আর একটি থেকে আরও অসংখ্য ভুল জন্ম নেয়।
সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কন্টেইনার না থাকাটাই সমস্যার প্রধান দিক। তাছাড়া, বৈশ্বিকভাবে বাণিজ্যে মহামারির অভিঘাত ছিল তীব্র তবে সংক্ষিপ্ত। গেল বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের সংশোধিত মৌসুমি লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও এগিয়ে যায় বাণিজ্যের পরিমাণ। এ সময় ধনী দেশে চিকিৎসা উপকরণসহ স্থায়ী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ছিল তার প্রধান কারণ।
আমদানির এই চাহিদা পূরণ করতে ফিরতি পথে অসংখ্য জাহাজ কন্টেইনারশূন্য অবস্থায় আসে। অথচ প্রধান রপ্তানি উৎস চীনে খালি কন্টেইনার দরকার ছিল, কিন্তু একমুখী যাত্রায় লাভ বাড়াতে কার্গো জাহাজ সেগুলো না নিয়েই দ্রুত চীনে ফিরে আসে। এতে করে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বন্দরগুলোতে অতিরিক্ত কন্টেইনারের চাপ সৃষ্টি হয়, বিপরীতভাবে এশিয়ায় দেখা দেয় স্বল্পতা। ফলশ্রুতিতে রপ্তানি রুটগুলোতে এখন আকাশচুম্বী কন্টেইনার ভাড়া ।
এই উচ্চমূল্য ও তার সঙ্গে ফিরতি পথে খালি জাহাজ ফেরার খরচ যোগ হয়ে সামগ্রিক জাহাজ পরিবহন শিল্পেই উচ্চ ব্যয় সৃষ্টির ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও করছে শিল্পটি। যেমন; গত মাসেই লস অ্যাঞ্জেলস বন্দর থেকে ৩,৬০,০০০ খালি কন্টেইনার ফিরিয়ে নিয়ে গেছে কার্গো জাহাজ। স্বাভাবিক মৌসুমের চাইতে এই পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
কিন্তু, যেখানে পণ্য ধারক বাক্সগুলো দরকার সেখানে সেগুলো ফিরে আসার পরই হবে সবচেয়ে বড় সমস্যার উদয়। বিশ্ব অর্থনীতির গতি হারানোর প্রক্রিয়া মহামারি হানা দেওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এ অবস্থায় ২০১৮ সাল থেকেই পরিমাণে কমেছিল বাণিজ্যিক ট্র্যাফিক। কেবলমাত্র চলতি বছরের শুরুর দিকে এসে আগের অবস্থায় ফেরে বিশ্ব বাণিজ্যের এই চক্র।
পশ্চিমা বিশ্ব ও চীন দ্বন্দ্বে আগামী দিনে বাণিজ্যের ভূমিকা সীমিত হবে, এমন অনুমান করে ইতোমধ্যেই ফ্রেইট শিল্প বিনিয়োগ কমিয়েছে। ২০১৯ সালের মার্চের পর থেকে এখাতে মায়েরস্কের মূল বিনিয়োগ মাত্র ২৯০ কোটি ডলারে নেমে আসে। অথচ ২০১৪ সালের মাত্র এক প্রান্তিকেই এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছিল জাহাজ শিল্পের জায়ান্টটি। বিনিয়োগের এই অভাব পূরণে আগামীতে বহু বছর ধরে প্রয়োজন হবে নতুন জাহাজ নির্মাণ, বন্দরের পোতাশ্রয় উন্নয়ন ও এমনকি কার্গো ওঠানামায় ব্যবহৃত ক্রেনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বিপুল কর্মযজ্ঞ।
জাহাজের চলাচল গতি বাড়িয়ে, বহরকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এক সময় চাপ এড়ানোর সুযোগ ছিল জাহাজে পণ্য পরিবাহক সংস্থার। সেই সুযোগও এখন নেই। কারণ ইতোমধ্যেই দৈত্যাকৃতির সব জাহাজের মাধ্যমে নিজেদের বহর সাজিয়েছে বড় সংস্থাগুলো। আবার জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্যে সেগুলোর ইঞ্জিনের সর্বোচ্চ গতি ১৮ থেকে ১৯ নটে নামিয়ে আনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক মরগ্যান স্ট্যানলির বিশ্লেষক দলও জানিয়েছে, গতি বাড়িয়ে সামনের অচলাবস্থা এড়ানোর উপায় আর নেই।
বাস্তবতা হলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই জাহাজে পণ্য পরিবাহী শিল্পও সব সময় এক অবস্থানে থাকে না। নতুন সঙ্কটও হয়তো এক সময় কেটে যাবে। ভাড়া বাড়ায় বিগত সাত বছরে মায়েরস্ক যে মুনাফা করেছিল, চলতি বছরে তার সমান মুনাফা করবে বলে বিশ্লেষকরা আভাস দিয়েছেন। বাড়তি মুনাফা একসময় নতুন জাহাজ ও কন্টেইনার নির্মাণেও গতি আনবে। ফলে ২০১৬ সালের মতো কন্টেইনার আধিক্যও হয়তো দেখা যাবে এক সময়।
কিন্তু, তার আগে জাহাজ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতিকে পাড়ি দিতে হবে এক অনিশ্চিত সময়। মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে যে নির্ভরতার পরিমাণও বাড়বে। এক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির প্রধান অন্তরায়। কিন্তু, বড় জাহাজের মোড় পরিবর্তনের মতোই এক্ষেত্রেও অনেকটা সময় লাগবে নিশ্চিতভাবেই।
- লেখক: পণ্যদ্রব্য, শিল্প ও ভোক্তাপণ্য উৎপাদক কোম্পানি নিয়ে ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট ডেভিড ফিকলিং। ইতঃপূর্বে তিনি প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন ব্লুমবার্গ নিউজ, ডাউ জোন্স, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও দ্য গার্ডিয়ানের মতো বিখ্যাত গণমাধ্যমে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত