তুর্কমেনিস্তান: ‘কোভিডমুক্ত’ দেশে যখন কেউ করোনা রোগী
তুর্কমেনিস্তান বিশ্বের গুটিকয়েক দেশের মধ্যে একটি, যারা দাবি করেছে, তাদের দেশে কোনো কোভিড রোগী নেই। কিন্তু রিপোর্ট বলছে, খুব সম্ভবত তারা তৃতীয় ও করোনার সবচেয়ে শক্তিশালী তরঙ্গের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সায়াহাত কুরবানভের (ছদ্মনাম) দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একটু নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছিলেন তিনি। তার অবস্থা দেখে মনে হতেই পারে, কিছুক্ষণ আগে ম্যারাথন দৌড়ে এসেছেন। করোনাভাইরাসের সকল উপসর্গই তার মধ্যে ছিল।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সরকারি হিসাবমতে তুর্কমেনিস্তানে কুরবানভের মতো রোগীদের কোনো অস্তিত্বই নেই।
তাই গত মাসে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার জানান, তার নিউমোনিয়া হয়েছে এবং দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিত। কুরবানভ অবশ্য জানতেন, দেশের ডাক্তাররা কোভিড আক্রান্ত হওয়াকে নিউমোনিয়া বলেই সম্বোধন করেন!
এর কিছুদিন আগেই একটি ক্লিনিকে নিজের কোভিড পরীক্ষা করাতে দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে কল দেওয়ার পর তাকে বলা হলো, 'হ্যাঁ, পজিটিভ এসেছে।' তিনি চিৎকার করে জানতে চাইলেন, 'কী পজিটিভ? কোভিড?' উত্তর এলো, 'হ্যাঁ'।
এরপরই সায়াহাত কুরবানভ বুঝে যান, তুর্কমেনিস্তানে কোভিড পজিটিভ হলে তার প্রমাণস্বরূপ কোনো কাগজপত্র দেওয়া হয় না।
সেদিন দুটি হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি কুরবানভ। 'হাসপাতালে যাওয়ার পথে প্রায় মরতে বসেছিলাম আমি, ভাইরাস দ্রুত আমার শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তারা আমাকে অক্সিজেন দিয়েছিল, কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি', বলেন তিনি।
আতঙ্কিত হয়ে একজন ডাক্তারের কাছে সাহায্য ভিক্ষা চাইছিলেন কুরবানভ, 'আমি কী করব? এখানে মরে পড়ে থাকব?'
একাধিক ফোনকল ও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের পর অবশেষে তাকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয়। পরবর্তী ৫ দিনেও তার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
কুরবানভ বলেন, 'তুর্কমেনিস্তানে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানেই যে আপনি চিকিৎসা পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছি। আমি চিৎকার করে নার্সকে ডাকছিলাম, আমার ব্যথা কমানোর জন্য কিছু দিয়ে যেতে।'
কিন্তু হাসপাতালে ডাক্তাররা প্রায়ই রোগীদের অগ্রাহ্য করেন। নার্সরা তাদের চেক-আপ করেন না, যদি না ক্ষমতাধর কেউ তাদের কল দিয়ে নির্দেশ দেন।
'হাসপাতালে মাত্র দু-চারজন নার্স ৬০ জন রোগীর দেখাশোনা করার দায়িত্বে ছিলেন। এমনও হয়েছে, একদিন এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী এসে ইনজেকশন দিয়েছেন', বলেন কুরবানভ।
এদিকে নার্সরা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেন, তারা চোখের সামনে রোগীদের মারা যেতে দেখেছেন। কারণ হাসপাতালে ভেন্টিলেটর নেই এবং অক্সিজেন মেশিনও কাজ করে না।
বিদেশভিত্তিক তুর্কমেন গণমাধ্যমগুলোতে কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গের সংক্রমণের কথা উঠে এলেও, দেশের ভেতরে প্রায় সবাই এই বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পায়।
তুর্কমেনিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা জনসাধারণকে জানায় না। প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গুলি বারদিমুখামেদভ তার 'স্বাস্থ্যবান জাতি' প্রোপাগান্ডাকে সামনে রেখে সবকিছু আড়াল করতে ব্যস্ত। কারণ, দেশে মহামারির অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলে এটি তার সরকার পরিচালনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তবে গত বছর রাজধানী আশগাবাতে এক তুর্কি কূটনীতিবিদ অসুস্থ হওয়ার পর জনগণের সামনে সত্য উন্মোচিত হয়। কূটনীতিবিদ কামাল উচকুনের বুক ব্যথা, শরীর ঘেমে যাওয়া, জ্বরসহ সাধারণ কোভিড উপসর্গ দেখা দেয়। কিন্তু ডাক্তাররা জানান, তার নিউমোনিয়া হয়েছে।
সে কথা বিশ্বাস না করে কামালের স্ত্রী গুজিদে উচকুন তার স্বামীর বুকের এক্স-রে রিপোর্ট তুর্কি হাসপাতালে পাঠান। সেখান থেকে নিশ্চিত করা হয়, কামাল কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন।
কামাল উচকুনের স্ত্রী স্বামীকে নিয়ে তুরস্কে ফিরতে চাইলেও তুর্কমেনিস্তান কর্তৃপক্ষ তাকে চিকিৎসা সরঞ্জাম-সম্পন্ন বিমান দিতে রাজি হয়নি। কামাল উচকুন মারা যাওয়ার কয়েক ঘন্টা পর সেই অনুমতি দেওয়া হয়।
কামালের লাশ সুগন্ধি দিয়ে সংরক্ষণ করা হয়। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তার মৃতদেহে কোভিডের কোনো লক্ষণ পাননি।
তুর্কমেন কর্তৃপক্ষ কোভিড সংক্রমণ প্রতিহত করতে ঢিলেঢালা কোয়ারেন্টাইন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের দাবি, তাদের 'প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা'র কারণেই দেশটি এখন কোভিডমুক্ত।
হাসপাতালে থাকার সময় সায়াহাত কুরবানভের ফোনে একটি স্বাস্থ্য-সচেতনতামূলক ক্ষুদে বার্তা আসে। ওই ক্ষুদে বার্তায় বাইরের ধুলাবালি থেকে বাঁচার জন্য জনসাধারণকে মাস্ক পরতে বলা হয়।
বিস্মিত কুরবানভের প্রশ্ন, 'আমরা কি ধুলাবালিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছি? তারা মানুষকে মরে যেতে দিবে, তবু স্বীকার করবে না দেশে কোভিড রয়েছে।'
-
সূত্র: বিবিসি