দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাইডেন সরকার
ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সম্পদশালী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে দারিদ্র্য ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের হার রীতিমতো বিস্ময়কর। নৈতিকতার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিষয়টি একটি কলঙ্কের চিহ্ন। তবে, বুধবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের 'আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান" শীর্ষক ১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের মাধ্যমে এই কালিমা মুছার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি।
নতুন এই প্রকল্পের সবথেকে স্মরণীয় দিক হতে যাচ্ছে শিশু দারিদ্র্য হ্রাসের বিধানগুলো। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষণা বলছে, উদ্যোগগুলোর চিরস্থায়ী বিধান সম্ভব হলে শিশু দারিদ্র্যের হার কমে অর্ধেকে নেমে আসবে। অর্ধেক! ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্ট প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বাইডেনও সম্ভবত শিশুদের জন্য তেমনই কিছু করবেন।
আমেরিকান নীতির এক আমূল পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে নতুন এই নীতিমালা। সেই সাথে, দেরীতে হলেও শিশুদের দারিদ্র্য হ্রাসে সর্বস্তরের সমাজের অংশগ্রহণকেও স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। তবে, সম্ভাব্য যে ফলাফল আসতে চলেছে, তা বুঝতে হলে অর্ধ পৃথিবী দূরে তাকাতে হবে।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে এই মাসেই গণহত্যা, অস্থিরতা আর দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জার সে সময় বাংলাদেশকে "তলাবিহীন ঝুড়ি" হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের এক দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ সব চিত্রে দেশটির ভাবমূর্তি কেবল নিরাশায় আচ্ছন্ন ছিল।
১৯৯১ সালে, বাংলাদেশে এক সাইক্লোনে এক লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ঘটনার উল্লেখ করে টাইম পত্রিকার এক প্রবন্ধে আমি হতাশা প্রকাশ করেছিলাম। আমি বলেছিলাম দেশটি, "শুরু থেকেই দুর্ভাগ্যের সাগরে নিমজ্জিত"। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও যে বাংলাদেশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়, সে সম্পর্কে আমি ঠিক ছিলাম। তবে, দেশটি সম্পর্কে আমার সর্বোপরি নেতিবাচক মনোভাব ছিল মারাত্মক এক ভুল। কেননা, পরবর্তী তিন দশকে বাংলাদেশ বিস্ময়কর আগ্রগতির নেতৃত্ব দেয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিরবচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বর্তমান মহামারির আগে টানা চার বছর দেশটির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ থেকে ৮ শতাংশ। এমনকি, প্রবৃদ্ধির এই হার চীনের চাইতেও দ্রুত।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ৭২ বছর। মিসিসিপির ১০টি কাউন্টিসহ যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু স্থানের তুলনায় এই আয়ুষ্কাল বেশি। একসময় হয়তো বাংলাদেশ হতাশার আদর্শ উদাহরণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে, দেশটির বিভিন্ন বিষয় থেকে উন্নতির পাঠ নিতে পারে বিশ্ব।
কিন্তু, বাংলাদেশের রহস্য কী ছিল? বাংলাদেশের সাফল্যের মূল রহস্য নিহিত আছে দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মেয়ে শিশুদের মাঝে।
১৯৮০'র দশকের শুরুতে, এক-তৃতীয়াংশেরও কম বাংলাদেশি প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করত। বিশেষত, নারী শিক্ষার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পেত না। অর্থনীতিতে নারীদের উল্লেখজনক অবদানও ছিল না।
কিন্তু, পরবর্তী সময়ে সরকার এবং নাগরিক সংগঠনগুলো নারীসহ সর্বজনীন শিক্ষার প্রচারণা চালায়। বর্তমানে বাংলদেশের ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। তবে তার থেকেও বিস্ময়কর বিষয় হল, ঐতিহাসিক ভাবে এখানে লিঙ্গ বৈষম্য থাকলেও, বর্তমানে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস আমাকে বলেছিলেন, "বাংলাদেশের সবথেকে নাটকীয় মোড়টি হল দরিদ্র থেকে শুরু করে সমাজের সকল নারীদের সামাজিক অবস্থানের পরিবর্তন।" গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূস। ব্যাংকটি দেশের নারীদের উদ্যোক্তায় রূপান্তরের কাজ করে যাচ্ছে। চার বছরে তারা প্রায় এক লাখ নারীকে "টেলিফোন লেডিজ'- এ পরিণত করেছে। মোবাইল সেবাদানে নিয়োজিত এই নারীরা নিজেদের এবং দেশের রূপান্তরে কাজ করে যাচ্ছেন।
মেয়ে শিশুদের শিক্ষাদান এবং ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশ শিক্ষিত নারীদের অর্থনীতির স্তম্ভ হিসেবে গড়ে তুলছে। দেশটির পোশাক শিল্প কারখানা অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। এই মুহূর্তে আপনি যে শার্টটি পড়ে আছেন, হতে পারে এটি তাদেরই কারও তৈরি। কেননা, চীনের পর এখন বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক শিল্প রপ্তানিকারক।
এ কথা সত্যি যে, পশ্চিমা মানদণ্ড অনুযায়ী দেশটির কারখানায় বেতনের হার কম। এমনকি এখানে যৌন হয়রানি সহ নানা ধরণের নিপীড়নের অভিযোগও আছে। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিসহ আছে নিরাপত্তাজনিত নানা ঝুঁকি। ২০১৩ সালে এক কারখানা ধসে ১,১০০-র অধিক কর্মী নিহত হন। কিন্তু, এখানকার পোশাক শ্রমিকরা নিজেরাই বলছেন যে, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া কিংবা ক্ষেতে কাজ করার তুলনায় এই কাজ করা ভালো। তবে, পুরোপুরি না হলেও ইউনিয়ন এবং নাগরিক সমাজের চাপে শ্রমিকদের নিরাপত্তা অর্জনে বড় ধরনের পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষিত নারীরা, গ্রামীণ এবং ব্র্যাকের (আরেকটি উল্লেখজনক উন্নয়ন সংস্থা) মতো অলাভজনক প্রতিষ্ঠানেও বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। তারা শিশুদের টিকা দিচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর শৌচাগারের প্রচারণা চালাচ্ছেন, গ্রামবাসীদের পড়তে শিখাচ্ছেন। গর্ভ নিরোধকের বিষয়গুলোও ব্যখ্যা করছেন তারা। বাল্য বিবাহকেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব চিরকাল ধরেই বিতর্কিত। কিন্তু, মানব সম্পদের পিছে দেশটির বিনিয়োগ যে গতিশীলতার সৃষ্টি করেছে, তা থেকে আমরা সকলেই শিক্ষা নিতে পারি।
১৫ বছরে দেশটি ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে- বিশ্বব্যাংকের ভাষায় বাংলাদেশ "দারিদ্র্য হ্রাসে অনুপ্রেরণার নজির"। ১৯৯১ সালের পর অপুষ্টিতে থাকা শিশুদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে, অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ভারতের তুলনায় কম।
সন্দেহবাতিক পাঠকেরা সম্ভবত মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে বলছেন যে, অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে এই উন্নতি কার্যকর হবে না। কিন্তু, একসময় গড়ে সাতটি করে সন্তান থাকলেও বাংলাদেশি নারীদের বর্তমানে গড়ে দুইটি করে সন্তান আছে।
সংক্ষেপে, বাংলাদেশ তার সবথেকে কম ব্যবহৃত সম্পদ দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেছে। সবথেকে প্রান্তিক এবং কম উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। কেননা, এখান থেকেই সর্বোচ্চ ফলাফল আসবে। আমেরিকার জন্যও এই বিষয়টি সত্যি হতে পারে।
আমরা বিলিয়নিয়ারদের থেকে অধিক উৎপাদনশীলতা নিংড়ে আনতে যাচ্ছি না। দেশ হিসেবে, আমরা যদি সাতজনের মধ্যে সেই একজন শিশু যে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করতে পারছে না, তাদের সাহায্য করতে পারি, তবেই উপকৃত হব।
শিশু দারিদ্র্যকে লক্ষ্য করে বাইডেনের নতুন উদ্যোগ সম্ভবত বিষয়টি অর্জন করতে সক্ষম হবে। একই কারণে, রিফান্ডেবল চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিটের মতো কেন্দ্রীয় বিষয়কেও স্থায়ী করার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রান্তিক শিশুদের উপর বিনিয়োগ কেবল মানবিক একটি বিষয় নয়। বরং, বিষয়টি একটি জাতিতে মাথা তুলে দাঁড়াতেও সাহায্য করে।
- লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত।
- ইংরেজিতে পড়ুন: What Biden can learn from Bangladesh to eradicate poverty
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা