দোভাষী স্বামীদের আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাজ্য, পরিত্যক্ত স্ত্রীরা তালেবান আতঙ্কে দিন গুনছে
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দোভাষীর কাজ করতেন মোহাম্মাদীর স্বামী। মোহাম্মাদী থাকেন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে। এখন তার দিন কাটে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায়।
নিজেকে প্রতিনিয়ত একটাই প্রশ্ন করেন মোহাম্মদী—তালেবানরা পৌঁছার আগে ব্রিটিশরা তাকে উদ্ধার করতে আসবে তো? মোহাম্মাদীর আশঙ্কা, তিনি এখন তালেবান খুনিদের লক্ষ্য।
৩৪ বছর বয়সি মোহাম্মাদী এখনও পর্যন্ত ব্রিটেনে স্বামীর কাছে যেতে পারেননি। তার অভিযোগ, 'নিষ্ঠুর' যুক্তরাজ্য সরকার তাকে স্বামীর সঙ্গে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।
ডেইলি মেইলকে মোহাম্মাদী বলেন, 'ব্রিটেন নারীর অধিকারে বিশ্বাস করে, নারীদের কথা শোনে। কিন্তু দেশটি আমাকে পরিবারের সাথে বসবাসের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে।'
ব্রিটেনে সরিয়ে নেওয়া এক ডজন দোভাষীর স্ত্রী স্বামীদের সঙ্গে থাকার অধিকার পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। মোহাম্মাদীও আছেন তাদের মধ্যে। তাদের আশঙ্কা, আগামী ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার পর তালেবানরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদের ওপর আক্রমণ চালাবে।
এই দোভাষীদের স্ত্রীদের অভিযোগ, যুক্তরাজ্য সরকার 'বিপজ্জনক' ও 'অযৌক্তিকভাবে' তাদেরকে পারিবারিক জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। ওই দোভাষীদের যুক্তরাজ্যে আশ্রয় দেওয়ার সময় এই নারীদের সঙ্গে তাদের বাগদান হলেও বিয়ে হয়নি। এ কারণে এই নারীরা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি পাননি।
তাদেরকে এখন অভিবাসন ও আশ্রয়ের জন্য প্রযোজ্য সাধারণ নিয়মের আওয়ায় আবেদন করতে হবে। এ নিয়মের অধীনে প্রার্থীদের অবশ্যই ইংরেজি বলার সক্ষমতা থাকতে হয়। ব্রিটেনে অভিবাসী হওয়ার সময় দোভাষীরা বিবাহিত থাকলে তাদের স্ত্রীরা এখন যুক্তরাজ্যে স্বামীর সঙ্গে যোগ দিতে পারতেন।
ব্রিটেনে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার পরে ওই দোভাষীরা বিয়ের জন্য আফগানিস্তানে ফিরে এসেছিলেন। তারা এখন যুক্তরাজ্যে আছেন। স্ত্রীদের যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসার জন্য আবেদন করলেও তাদের আবেদন মঞ্জুর হয়নি।
তাদের স্ত্রীরা আইনজীবী মারফত যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তারা এই সিদ্ধান্তের বিচারিক পর্যালোচনা চাইবেন।
মোহাম্মাদী বলেছেন, 'আমার স্বামী ব্রিটেনের জন্য যে কাজ করেছে, তার জন্য আমি বিপদে আছি। আমাকে শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে ওকে শাস্তি দেবে ওরা। আমার দিন কাটছে প্রচণ্ড আতঙ্কে। দুই বছরেরও আগে ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম আমি। তখন বলা হয়েছিল, আট সপ্তাহের মধ্যে আমি ইংল্যান্ডে যেতে পারব। কিন্তু দুই মাস আগে জানানো হয়, আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।'
তার স্বামী, ৩৭ বছর বয়সি আহমদ এসএএস ও এসবিএস-এর জন্য ১১ বছর যুদ্ধক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ২০১৬ সালে তিনি আহত হন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ব্রিটেনে চলে যান।
পরের বছরের জুলাইয়ে মোহাম্মদীকে বিয়ে করতে আফগানিস্তানে ফেরেন তিনি। সেই থেকে একসঙ্গে যুক্তরাজ্যে থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
আহমদ জানান, যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার স্ত্রীর আবেদন পর্যালোচনা করে দেখছে। কিন্তু তাদের আনুষ্ঠানিকটা শেষ হতে অন্তত তিন মাস লাগবে। আফগানিস্তানে রেখে আসা পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে না পেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেক দোভাষী।
আফগানিস্তানে প্রতিনিয়ত আগের চেয়ে শক্তিশালী হচ্ছে তালেবান। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর দেশটি ছেড়ে চলে যেতেও আর বেশিদিন বাকি নেই। ক্ষমতা দখলের পর তালেবানরা বিদেশি বাহিনীকে সাহায্য করা দোভাষীদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। কাজেই তাদের পরিবারকে যত দ্রুত সম্ভব আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেওয়া দরকার।
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে যুক্তরাজ্যের হয়ে কাজ করা ১৫০০ আফগান কর্মচারী ও তাদের পরিবারকে যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আগামী মাসগুলোতে আরও কয়েক হাজার কর্মচারীকে যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।
সময় ফুরিয়ে আসছে
হেলমান্দের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঁচ বছর ব্রিটিশ বাহিনীর দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন সেলিম। তার সঙ্গে বিয়ে ঠিক ছিল ব্রেখনার। কিন্তু সেলিমের ভাইকে তালেবানরা অপহরণ করায় তাদের বিয়ে পিছিয়ে যায়।
২০১৬ সালে সেলিম যুক্তরাজ্যে যান। তখন ব্রেখনা তার বাগদত্তা ছিলেন। পরের বছর বিয়ের জন্য আফগানিস্তানে ফেরেন সেলিম। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতি পেতে ব্যর্থ হন ব্রেখনা। ইংরেজি না জানা তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বড় কারণ।
২১ বছর বয়সি ব্রেখনা ডেইলি মেইলকে বলেন, 'আর কখনও স্বামীর সঙ্গে দেখা হবে কি না জানি না। ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছি আমি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি স্বামীর কাছ থেকে দূরে আছি। প্রতিদিন ওকে জিজ্ঞেস করি, একসঙ্গে যদি থাকতে না-ই পারি, তাহলে আমরা বিয়ে করলাম কেন? এটা অন্যায়।'
ব্রেখনার স্বামী সেলিম বলেন: 'সরকারের কাছে আমি সাহায্য চেয়ে আবেদন করেছি। আমার স্ত্রীর পক্ষে ইংরেজি শেখা সম্ভব নয়। আমার পরিবার যেখানে থাকে, সেখানে ভাষা শিক্ষার কোনো স্কুল নেই। আর এই সময় কোনো মহিলা ইংরেজি শিখতে শুরু করলেই তালেবানের টার্গেটে পরিণত হবে।
'আমার স্ত্রীকে এখানে আনার জন্য আর মাত্র কয়েক মাস সময় পাব। এরপর তালেবানরা ক্ষমতার দখল নেবে। তখন ওকে এখানে আনা ভীষণ কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়াও ও তখন তালেবানের টার্গেটে পরিণত হবে।'
অন্তঃসত্ত্বা রাহিমির সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
যে কোনো দোভাষীর স্ত্রীকে যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য সাধারণ প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করতে হয়। দেশটিতে যাওয়ার অনুমতি পাওয়ার একটি শর্ত হলো ইংরেজি বলার সক্ষমতা। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা রাহিমির পক্ষে ইংরেজি শেখা সম্ভব নয়।
তার স্বামী ফাহিম চার বছর দোভাষীর কাজ করার পর ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যে চলে যান। দীর্ঘদিন পর তিনি দেশে আসেন স্ত্রীকে দেখতে। এরপর অন্তঃসত্ত্বা হন রাহিমি। স্বামীর সঙ্গে যুক্তরাজ্যে যোগ দেওয়ার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন তিনি। কিন্তু ছয় সপ্তাহ আগে প্রত্যাখ্যান করা হয় তার আবেদন।
৩০ বছর বয়সী ফাহিম জানান, তালেবানরা নারীদের ইংরেজি শেখার অনুমতি দেয় না। নিরুপায় হয়ে রাহিমি এখন ইউটিউব থেকে ইংরেজি শেখার চেষ্টা করছেন।
অন্তঃসত্ত্বা রাহিমিসহ এমন আরও অনেক অসহায় আফগান নারীর দিন কাটছে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায়। স্বামীদের সঙ্গে ব্রিটেনে থাকার সৌভাগ্য হবে, নাকি স্বামীদের 'অপরাধে'র মূল্য তাদেরকে চুকাতে হবে—তা জানেন না এই নারীদের কেউই।
- সূত্র: ডেইলি মেইল