নয়েস্টাট আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলেন ইসমাইল কাদরি
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস গত ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানায়, সম্প্রতি নয়েস্টাট আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন ইসমাইল কাদরি। আন্তর্জাতিক সাহিত্যে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এটি। একে নোবেল পুরস্কারের সঙ্গেও তুলনা করা হয়।
কিন্তু কে এই ইসমাইল কাদরি?
শুধু লেখকই নন, ইসমাইল কাদরি একজন আলবেনিয়ান ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক। তার লেখায় উঠে এসেছে আলবেনিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি। একবিংশ শতাব্দীর খ্যতিমান পশ্চিমা লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
সাহিত্য জগতে তার হাতেখড়ি কবি হিসেবে হলেও পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বনন্দিত কথাসাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেন। ২০০৫ সালে ম্যানবুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই আলবেনীয় লেখক দীর্ঘদিন ধরে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়ে আসছেন। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নোবেলজয়ী হতে পারেননি এখনো। অবশ্য লেখা পড়লেই বোঝা যায়, তিনি একজন যোগ্য দাবিদার!
তার লেখায় শুধু সাহিত্যের ছোঁয়া নয়, রয়েছে রম্য রচনা, ইতিহাস, পৌরাণিক কাহিনি ও রূপক গল্পের স্বাদ।
সাহিত্যিক হিসেবে যখন তার উত্থান, তখন আলবেনিয়ায় চলছিল বামপন্থি স্বৈরশাসক এনভার হোজ্জার (১৯৪৪-৫৪) শাসনামল। সেই শাসনামলের বুদ্ধিদীপ্ত ও পর্যায়ক্রমিক সমালোচনা এবং প্রতিবাদ তার লেখায় নিঃসংকোচে স্থান পেয়েছে।
তার লেখনীতে রাজনীতি ও ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত।এ কারণে তাকে সহ্য করতে হয়েছে বহু বিতর্ক ও সমালোচনা।১৯৯০ সালে হোজ্জার তোপের মুখে পড়ে দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে পাড়ি জমান তিনি।
২৬ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস 'দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি' প্রকাশ পায়। এই উপন্যাস তাকে আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে নিয়ে গেছে। মনোমুগ্ধকর ও শাণিত ভাষায় রচিত 'দ্য জেনারেল অব স্য ডেড আর্মি' একজন ইতালিয়ান জেনারেলের গল্প, যার ওপর দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ইতালিয়ান সৈন্যদের মরদেহ ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব।
১৯৬৩ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস মাস্টারপিস হিসাবে প্রশংসা কুঁড়ায় এবং আয়রন কার্টেনের (একটি রাজনৈতিক সীমানা, যা ইউরোপকে দুটি অঞ্চলে ভাগ করেছে) বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলার জন্য ফরাসি বুদ্ধিজীবীরা তাকে স্বাগত জানান।
এই উপন্যাস পরবর্তীকালে ১২ টি ভাষায় অনূদিত হয়। এছাড়া দুটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে উপন্যাসটিকে ঘিরে। তারমধ্যে একটি উপন্যাসের নামেই নির্মিত, যার পরিচালক মাইকেল পিকোলি। অপরটি বার্নান্ড তাভেনিয়ার পরিচালিত 'লাইফ অ্যান্ড নাথিং এলস'।
তার অন্য দুটি বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য প্যালেস অব ড্রিমস' এবং 'দ্য পিরামিড'-এ যথাক্রমে অটোম্যান সাম্রাজ্য এবং প্রাচীন মিশরের বর্ণনা পাওয়া যায়।
আলবেনিয়ার জিনোকাস্টার শহরে এই গুণীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেছেন তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যে এবং মস্কোর জগতখ্যাত গোর্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে। লন্ডনের পত্রিকা 'দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট'-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসমাইল কাদেরিকে রুশ নাট্যকার নিকোলাই গোগল, জার্মান ঔপন্যাসিক ফ্রাঞ্জ কাফকা এবং বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের সঙ্গে তুলনা করা হলেও তার রয়েছে স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্ব গভীরতা।
'দ্য গ্রেট উইন্টার'-এ রয়েছে ক্রউসচেভের শাসনামল এবং 'দ্য কনসার্ট'-এ মাও সে তুং পরবর্তী চীনের বর্ণনা। অন্যদিকে, 'দ্য ক্যাসেল অব দ্য সিজ' বইটি তিনি অটোম্যানদের বিরুদ্ধে আলবেনীয়দের সামরিক অভ্যুত্থান ঘিরে লিখেছেন।
'ক্রনিক্যাল ইন স্টোন'-এ তুলে ধরেছেন যুদ্ধবর্তীকালে জিনোকাস্টারে কাটানো তার ছোটবেলার চিত্র। অন্যদিকে, 'দ্য সাকসেসর' হলো আলবেনীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে একটি রাজনৈতিক থ্রিলার।
এ পর্যন্ত ৪৫টি ভাষায় অনূদিত হলেও বাংলায় তার বই খুব বেশি বই অনুবাদ হয়নি। যে কয়েকটি হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই সুখপাঠ্য নয়। তবে বইয়ের জাহাজ প্রকাশনীর 'দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি' ও রোদেলা প্রকাশনীর 'দ্য পিরামিড' বই দুটোর অনুবাদ বেশ ভালো।
ইসমাইল কাদরির লেখায় শুধু আলবেনীয় ইতিহাস, রাজনীতি, লোককাহিনি, ঐতিহ্য, জাতি প্রভৃতি উপাদানই নয়; বরং আরও রয়েছে রোমান্টিকতাবাদ, বাস্তববাদ ও পরাবাস্তববাদ। পাঠককে নতুন এক জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে তার লেখা।
- সূত্র: ব্রিটানিকা, দ্য গার্ডিয়ান, এপি ও প্যারিস রিভিউ