পানশির লড়াইয়ে গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা রয়েছে: মার্কিন কর্মকর্তা
আফগানিস্তানের পানশির উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ দখলে শনিবার (৪ আগস্ট) তালেবান ও পানশির বিদ্রোহী বাহিনীর মাঝে তুমুল লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। রাজধানী কাবুলের উত্তরে অবস্থিত একমাত্র এই প্রদেশই এখনো তালেবান নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।
দু'পক্ষের তীব্র লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে একজন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা গৃহযুদ্ধের সতর্কবার্তা দিয়েছেন। যদি তালেবান দল দ্রুতই ওই প্রদেশের দখল নিতে না পারে, তাহলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
উভয় পক্ষই পানশির দখলের দাবি করলেও কেউই সেইসব দাবির পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম শাসন আমলেও তালেবানরা পানশির উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
তালেবান মুখপাত্র বিলাল করিমি জানিয়েছেন, খিনজ ও উনাবা জেলা দখলের পর প্রদেশটির সাতটি জেলার মধ্যে চারটির নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবান বাহিনীর হাতে।
টুইটারে তিনি বলেন, 'মুজাহিদিনরা (তালেবান যোদ্ধারা) কেন্দ্রের (প্রদেশের) দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।'
কিন্তু আহমদ মাসউদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল রেজিস্টেন্স ফ্রন্ট (এনআরএফ) বলছে, তারা খাওয়াক পাসে 'হাজার হাজার সন্ত্রাসীকে' ঘিরে রেখেছে এবং তালেবানরা দাশতে রেওয়াক এলাকায় যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্র ফেলে চলে গেছে।
দলটির মুখপাত্র ফাহিম দাশতি আরও জানিয়েছেন, 'তুমুল সংঘর্ষ' চলছে।
এক ফেসবুক পোস্টে মাসউদ লিখেছেন, 'পানশির দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করছে।'
নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত নারীদের প্রশংসায় তিনি আরও লিখেন, 'পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত শহরে নারীরা তাদের অধিকারের দাবিতে যে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, তা প্রমাণ করে আফগানরা ন্যায়বিচারের দাবি ছেড়ে দেয়নি এবং তারা কোনো হুমকিকে ভয় পায় না।'
এদিকে, মার্কিন জেনারেল মার্ক মিলি চলমান নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মিলি বলেন, 'আমার সামরিক অনুমান হলো, গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমি জানি না তালেবান বাহিনী ক্ষমতা সংহত করে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি না।'
জার্মানির রামস্টেইন বিমান ঘাঁটি থেকে ফক্স নিউজকে মিলি আরও বলেন, 'যদি তারা তা না করতে পারে, তাহলে আল কায়েদার ও আইএসআইএস-এর পুনর্গঠনসহ অন্যান্য অসংখ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম ও বৃদ্ধি হতে পারে এ অঞ্চলে।'
পানশির এলাকায় চিকিৎসা সুবিধা সরবরাহকারী ইতালির সংস্থা ইমার্জেন্সি জানিয়েছে, তালেবান বাহিনী শুক্রবার রাতে এক সংঘর্ষের মাধ্যমে পানশির উপত্যকার আনাবা গ্রামে পৌঁছেছে।
সংস্থাটি আরও জানায়, 'আমরা আনাবা সার্জিক্যাল সেন্টারে অল্পসংখ্যক আহত মানুষ পেয়েছি। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে সেখান থেকে অনেক লোক পালিয়ে গেছে।'
বিজয় উদযাপন
এদিকে, তালেবানদের পানশির দখলের খবর ছড়িয়ে পড়ায় শুক্রবার কাবুলে উৎসবমুখর গোলাগুলি শুরু হয়। সংবাদ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, পানশির বিজয় উদযাপনের গোলাগুলিতে কমপক্ষে ১৭ জন নিহত ও ৪১ জন আহত হয়েছেন।
শনিবার পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদ কাবুলে পৌঁছেন। তবে, এ সময়ে তার কাবুল সফরের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়।
এর আগে, সপ্তাহের শুরুতে পাকিস্তানের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছিলেন, তালেবানকে আফগান সামরিক বাহিনী পুনর্গঠনে সহায়তা করতে পারেন পাকিস্তানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) এজেন্সির প্রধান হামিদ।
ওয়াশিংটন বরাবরই পাকিস্তান ও আইএসআই'কে তালেবান সমর্থনে অভিযুক্ত করে আসছে; তবে, ইসলামাবাদ এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে।
অন্যদিকে, কাবুলে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত একদল নারীকে উদ্দেশ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে ছোঁড়ার অভিযোগ উঠেছে তালেবান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
নারী দলটি বলছে, তারা পায়ে হেঁটে রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে পথিমধ্যে তালেবানরা তাদের লক্ষ্য করে এ আক্রমণ চালায়। ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
রয়টার্সকে বিক্ষোভকারী সুরায়া বলেন, 'তালেবানরা বন্দুকের ম্যাগাজিন দিয়ে নারীদের মাথায় আঘাত করে তাদের রক্তাক্ত করেছে।'
তালেবানরা ইসলামি আইনের কঠোর ব্যাখ্যা দেওয়া এবং তা বাস্তবায়নের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এর আগের শাসনামলে তারা নারীদের শিক্ষা গ্রহণ, বাইরে কাজ করা, এমনকি বাড়ির বাইরে একা বের হওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল।
নতুন সরকার গঠন সামনের সপ্তাহে
তালেবানের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী সপ্তাহে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা আসতে পারে।
তালেবানের যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদার নতুন সরকারের নেতৃত্ব দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া সরকার ব্যবস্থায় আফগানিস্তানের সকল জাতিগোষ্ঠীকে সমন্বয় করা হবে বলেও জানা গেছে।
তালেবানের একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা জনগণের উন্নত জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। সরকার নিরাপত্তা দেবে। কারণ এটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন।'
এদিকে, কাবুলের পরিস্থিতিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে।
আফগানিস্তানে কাতারের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, একটি টেকনিক্যাল টিমের সহায়তায় কাবুল বিমানবন্দরে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পুনরায় চালু হয়েছে।
এর আগে, ৩০ আগস্ট কাবুল থেকে সম্পূর্ণভাবে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে কাবুল বিমানবন্দরটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তালেবানের প্রধান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদও কাবুল বিমানবন্দর পুনরায় চালু হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করেছেন।
তালেবানদের দখলের মুখে আফগানিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে এবং দেশে নগদ অর্থের অভাব দেখা দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিকে একটি মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর একটি আন্তর্জাতিক সহায়তা সম্মেলন আহ্বান করেছেন।
এছাড়া, পশ্চিমা শক্তিগুলো জানিয়েছে, তারা তালেবানদের আনুষ্ঠানিভাবে আফগান সরকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও দেশটির জনসাধারণের জন্য মানবিক সহায়তা পাঠাতে প্রস্তুত। তবে, বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহায়তা নির্ভর করছে তালেবাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের ওপর।
-
সূত্র: রয়টার্স