পুরুষের তুলনায় মন্দ অর্থনৈতিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে নারী বিনিয়োগকারীদের
এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ পুঁজিবাজার এবং আর্থিকখাতের ব্যবসা কেন্দ্র হংকং। আছে আন্তর্জাতিক মানের বন্দর, উদ্যমী ও উদ্ভাবনী উদ্যোক্তা এবং পুঁজি সরবরাহকারী ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। আর যুক্তরাষ্ট্র তো পৃথিবীর শীর্ষ অর্থনৈতিক পরাশক্তি। কিন্তু, তারপরও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিকখাতের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের উপর করা এক জরিপে দেখা গেছে, হংকং এবং যুক্তরাষ্ট্রে নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গের পরামর্শকই পুঁজি ব্যবস্থাপনায় নারী বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ মনে করেন।
আগে থেকেই কম দক্ষ মনে করার কারণে পরামর্শকরা নারী পুঁজি লগ্নিকারীদের ব্যবসায়িক পরিবেশের অপেক্ষাকৃত কম বিশ্লেষণ দেন। প্রায়শই এমন তথ্যের কারণে ব্যবসায়িক বৈঠকে ভুল বোঝাবুঝি এবং ব্যর্থতার শিকার হন নারীরা। এই প্রেক্ষিতেই যুক্তরাষ্ট্রে নারী সম্পদশালীরা পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপক এবং পরামর্শক ফার্মগুলোকে এড়িয়ে চলছেন।
পুরুষ বিনিয়োগকারীদের অবস্থান অবশ্য এর বিপরীত। তারা নারীদের মতো এতটা উদার হন। তারা পরামর্শকদের ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণের কারণে ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হলে, এব্যাপারে সরাসরি অভিযোগ এনে থাকেন। তবে নারীরা বেশি ত্রুটিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের কারণেই ধীরে ধীরে পরামর্শকদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন, বলে দেখা গেছে।
আর্থিকখাতের অন্যতম বৃহৎ পরামর্শক সংস্থা ম্যাককিনসে অ্যান্ড কো. সাম্প্রতিক গবেষণাটি করে। এর ভিত্তিতে, পুরুষশাসিত মার্কিন পুঁজি ব্যবস্থাপনা খাতকে নারী গ্রাহকদের প্রতি লিঙ্গ বৈষম্যের মনোভাব পরিহার করে নতুনভাবে তাদের আস্থা অর্জনের আহ্বান জানানো হয়।
ম্যাককিনসে প্রতিবেদনের বরাতে ব্লুমবার্গ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন নারীরা প্রায় ১০ লাখ কোটি ডলারের গৃহস্থালি সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আগামী এক দশকের মধ্যে এ সংখ্যা তিনগুণ বাড়বে।
হংকংয়ে সংস্থাটি দুই বছর মেয়াদি এক গবেষণা করে। এর আওতায় স্থানীয় সকল আর্থিকখাত পরিকল্পক সংস্থাকে আনা হয়। দেখা গেছে, এসব পরামর্শকরা নারীদের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ উপায় বাৎলে দিয়েছেন পুরুষদের তুলনায়। ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে উভয় লিঙ্গের বিনিয়োগকারীর মধ্যে একই ধরনের মনোভাব থাকা সত্ত্বেও পরামর্শকরা নির্দ্বিধায় নারীদেরকে বেশি ঝুঁকি সম্পন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপদেশ দেয়।
গবেষণায় অবশ্য সংশ্লিষ্ট শিল্পের অন্ধকার এক দিক উঠে আসে। গবেষকরা বলছেন, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত হলে বিনিয়োগকারী গ্রাহকের কাছ থেকে বেশি ফি আদায় করা যায়। অর্থাৎ, নারীদের আছ থেকে অন্যায্যভাবে বাড়তি আয়ের একটা অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। পরামর্শকরা মনে করে, পুঁজিবাজারের ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারে বিনিয়োগে নারীদের বারবার একই পরামর্শ দেওয়া হলে, তারা সেটি গ্রহণ করেন। এটাই তাদের মূল লক্ষ্য, যার ফলে তাদের মুনাফাও বাড়ে।
হংকং ইউনিবার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক এবং ম্যাককিনসে গবেষণা নিবন্ধের সহ-লেখক উৎপল ভট্টাচার্য বলেন, বিনিয়োগে অসন্তোষজনক ফলাফল আসবে নারী লগ্নিকারীদের এমন বাজে উপদেশ দিয়ে পার পেয়ে যাবেন, বলে মনে করেন পরামর্শকরা। এর অর্থ দাঁড়ায়, তারা নারীদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় পুরুষের তুলনায় অদক্ষ এবং অশিক্ষিত মনে করেন। আমরা এটাকেই পরিসংখ্যানের লিঙ্গ বৈষম্য বলে উল্লেখ করেছি ।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক আরেক সম্পদ ব্যবস্থাপক সংস্থা- মেরিল লিঞ্চ ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট আরেকটি চমকপ্রদ গবেষণা করেছে। তারা আর্থিক ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের বৈঠকে চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে। দেখা গেছে, বৈঠকের সময় নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গের পরামর্শকরা পুরুষ বিনিয়োগকারীর দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন, যার পরিমাণ ৬০ শতাংশ।
বিনিয়োগকারীরা উভয় লিঙ্গের দম্পতি হলেও, বেশি মনোযোগ পেয়েছেন পুরুষেরা। অর্থাৎ,তাদেরকেই মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আধাঘণ্টা বা ৩০ মিনিটের এক একটি বৈঠকে সম্পদ ব্যবস্থাপকরা গড়ে ১০ বার এমন ভুল করেছেন।
এসব ভুলের মধ্যে ছিল; দম্পতিদের মধ্য পুরুষ সঙ্গীকে মূল সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হিসেবে ধরে নেওয়ার বিষয়টি। দম্পতির সব সম্পদ একসাথে রয়েছে, এবং নারী সঙ্গিটি নিরাপদ সিদ্ধান্তের জন্য পুরুষ সঙ্গীর প্রতি নির্ভরশীল এমন সব পূর্বানুমান করেছেন পরামর্শকরা। এক্ষেত্রে আবার নারীদের চাইতে পুরুষ পরামর্শকেরা দ্বিগুণের বেশি অবহেলা করেছেন নারী গ্রাহকদের।