বাংলাদেশে শীর্ষ বিনিয়োগকারী চীনের সার্বিক অর্থনৈতিক উত্তরণ নির্ভর করছে ভোক্তাব্যয়ের ওপর
২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালের মে নাগাদ সরাসরি বিদেশি পুঁজি প্রবাহ ৬৭.৯৪ শতাংশ বেড়েছিল। ওই সময় আসা মোট ৩৬১ কোটি ডলারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ আসে এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতি চীন থেকে।
আর গত জুনে সমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ১১৬ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন।
বাণিজ্যিক সম্পর্কে বাংলাদেশকে সুবিধা দিতেও দেশটি পদক্ষেপ নেয়। গত ১ জুলাই চীনে রপ্তানিযোগ্য বাংলাদেশি পণ্যের সংখ্যা আগের ৬০% থেকে ৯৭% উন্নীত করে চীন। স্বল্পোন্নত (এলডিসি) বা এলডিসি দেশ বিবেচনায় দেওয়া এ সুবিধার আওতায় এখন ১ জুলাই থেকে চীনে শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করার অনুমতি পেয়েছে; মোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য। এত দিন এই সুযোগ ছিল ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ অবশ্য ২০২৪ সালেই এলডিসি তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে, তবে তার আগের চার বছর এ নীতির সুবিধা নিতে পারবেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
পাশাপাশি বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের অঙ্গিকার করেছে দেশটি। ২০১৬ সালে শি জিংপিংয়ের সফরের সময়- এদেশে বিনিয়োগের বিস্তৃত পরিকল্পনা ঘোষণা করে চীন। যার ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের আগস্ট নাগাদ স্বাক্ষরিত হয়েছে ২৭টি সমঝোতা চুক্তি, যার অর্থমূল্য ২৪শ' কোটি ডলার।
এছাড়া, দুই দেশের ব্যবসায়ীরা যৌথ উদ্যোগের আওতায় ১৩টি চুক্তি করেছেন; যার অর্থমূল্য আরও এক হাজার ৩৬০ কোটি ডলার। দ্য ডিপ্লোম্যাট সূত্রে এসব তথ্য সম্পর্কে জানা গেছে।
সব মিলিয়ে অতিবাহিত সময়ের সাথে সাথে- বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ অর্থনীতিটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক উন্নয়ন। তাই কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী সময়ে চীনের অর্থনৈতিক উত্তরণের ওপর- বাংলাদেশে বিনিয়োগ বা এদেশ থেকে রপ্তানির সুযোগ অনেকাংশে নির্ভর করছে।
বাংলাদেশি ব্যবসায়ী সমাজ এবং সাধারণ জনতার মধ্যেও- তাই চীনা অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে বেশ কৌতূহল কাজ করে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট সূত্রে এসম্পর্কে জানার প্রয়াস পাওয়া যায়।
অভ্যন্তরীণ ভোক্তারাই নির্ধারণ করবেন চীনের ভবিষ্যৎ:
করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে সবার আগে উন্মুক্ত হয় চীনের অর্থনীতি। এখন অনেকস্থানেই দেখা যাচ্ছে স্বাভাবিক পরিস্থিতি।
চীনের অন্যতম শিল্পশহর চেংদুর ব্যস্ততম সড়ক চুংশি রোডের চিত্রও- তার ব্যতিক্রম কিছু নয়। সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী শহরের এ বাণিজ্যিক সড়কে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য।
ক্রেতাদের ভিড়ে সড়কের ধারের জনপ্রিয় রেস্তোরাঁগুলো ব্যতিব্যস্ত। অনেক সময় পানাহার সারার জন্য ফাঁকা টেবিলের অপেক্ষায় আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের।
হুতাং নামের ওয়াক-ইন ধরনের একটি রেস্তোরার রিসেপশনিস্ট চিৎকার করে জানাচ্ছিলেন, 'ফাঁকা জায়গা নেই, দয়া করে অপেক্ষা করুন।'
মাত্র কয়েক মাস আগেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দেশটিজুড়ে যে কঠোর শাটডাউন চলেছিল, এ অবস্থা ঠিক তার বিপরীত। ওই সময়ে বিপুল ক্ষতির শিকার হয় স্থানীয় ব্যবসাগুলো।
জনসমাগম স্থলে চেংদুতে মাস্ক পড়া এখনও বাধ্যতামূলক। তবে মহামারির প্রভাব ধীরে ধীরে কাটছে, এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। অনেকস্থানেই ফিরেছে ভোক্তাদের সারি।
যেমন চেংদু'র চুংশি সড়কের ড্রাইভ-ইন বিপণীকেন্দ্র তাইকো-লি'তে। এখানে লাইনে দাড়িয়ে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করিয়েই মলে ঢুকছেন ক্রেতারা।
পান্ডার জন্য বিখ্যাত এ শহরে এভাবেই ফিরেছে ক্রয়কারী এবং রেস্তোরায় সুস্বাদু নৈশভোজ সারতে ইচ্ছুক ভোক্তাদের ভিড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে বিলাসপণ্য ক্রয়েও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তাদের। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিটি; ভোক্তাব্যয়ের উপর ভর করে করোনাভাইরাসের ধাক্কা কাটিয়ে উঠে সামনের দিকে অগ্রসর হবে, এমন আশাবাদ জোরালো হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালে জি-২০ জোটভুক্ত বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে চীন। সাম্প্রতিক সময়ে অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-র এক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়।
চলতি সপ্তাহেই বিশ্বব্যাংক জানায়, চলতি ২০২০ অর্থবছরে চীনের গড় দেশজ উৎপাদন প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ২ শতাংশ হারে বাড়বে। এর পেছনে ইতিবাচক প্রভাব যোগ করে দেশটির রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা।
গত বছর চীনের মোট জিডিপি'তে ভোক্তাব্যয়ের অবদান ছিল ৫৬ শতাংশ। এবছরও তাই স্থানীয় অর্থনীতির সম্প্রসারণ নির্ভর করবে ভোক্তাকূল তাদের গাঁটের পয়সা খরচ করতে কতোটা আগ্রহী হন, তার ওপর।
চলতি বছরের প্রথম আট মাসে চীনে খুচরা পণ্য ক্রয় এবং গৃহস্থালি খরচ বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং রপ্তানি আয়ের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। এ অবস্থায় ভোক্তাব্যয় কমতে থাকলে অর্থনীতির সার্বিক উত্তরন করোনাভাইরাস পুর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে পারবে না, এমন আশঙ্কার মাত্রা বাড়ে।
বিষয়টি অনুধাবন করেই, দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার করোনাভাইরাসের নতুন গুচ্ছ-সংক্রমণ হওয়া মাত্রই তা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত এবং যথার্থ পদক্ষেপ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে সেবাখাতকেও উন্মুক্ত করা হয়।
চীনজুড়ে কোনো প্রেক্ষাগ্রহ হোক বা বেইজিংয়ের কৃষিপণ্যের পাইকারি শিয়াংফেদি বাজার, যেখানেই গুচ্ছ-সংক্রমণ শনাক্ত হয়, অতিদ্রুত সেখানে ও আশেপাশের এলাকায় আঞ্চলিক লকডাউন কার্যকর করেছে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ।
সংক্রমণ অবশ্য মানুষ যে বাজারে যাচ্ছে এবং খরচ করছেন, সেদিকেও ইঙ্গিত করে। একারণে ভোক্তাব্যয় নিয়ে এখন ইতিবাচক আশা করা হচ্ছে।
এব্যাপারে এইচএসবিসি ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ শানশান সং ও এরিন জিন এক বাণিজ্যিক বিশ্লেষণ নোটে উল্লেখ করেন, ''নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য দ্রব্যের চাহিদা এবং সেবা ভোগের পরিমাণ- ভোক্তাদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আস্থা বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে উন্নতির দিকে যাবে। ফলে, আয়ের ঘাটতি কিছুটা কাটিয়ে ওঠাও সম্ভব।''
চীনের ভোক্তাব্যয়ের প্রাথমিক সূচকগুলো তুলনামূলক আশাবাদী চিত্র তুলে ধরছে। আগের বছরের তুলনায়, গত সেপ্টেম্বরে মোটরকারের বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। ওই মাসের প্রথম ২০ দিনে আসা এ উত্তরণ সম্পর্কে জানায়, চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন।
তাছাড়া, পুনরায় খুলে দেওয়ার পর বেড়েছে প্রেক্ষাগ্রহগুলোর আয়। এজন্য অবশ্য 'দ্য এইট হান্ড্রেড'-এর মতো সদ্য মুক্তি পাওয়া কিছু ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র ইতিবাচক অবদান যোগ করে।
চলতি সপ্তাহেই দেশটির প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং জানান, গত এপ্রিল থেকেই নাকি চীনে নিবন্ধিত ব্যবসার সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে এই সংখ্যায় পতন লক্ষ্য করা যায়।
লি বলেন, 'প্রথম আটমাসে দৈনিক গড়ে ১২ হাজার ব্যবসা নিবন্ধন নিয়েছে।' রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া তার উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানায়।
চীনের কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়া পরিবারগুলোকে সরাসরি নগদ অর্থ সাহায্যে ইচ্ছুক নয়, বরং তারা বিকল্প অন্যান্য উপায়ে তুলনামূলক স্বচ্ছলদের ভোক্তাব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্রদের আয়বৃদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে। এর আওতায় নানা পদক্ষেপ সমূহের মধ্যে অন্যতম; পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে যাওয়ার জন্য বিমানের ফ্রি টিকেট, পণ্যক্রয়ে ছাড়ের কুপন জারির মতো উদ্যোগ।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে আগামী ৮ অক্টোবর পর্যন্ত ঘোষণা করেছে 'চায়না কনসাম্পশন প্রমোশন মান্থ', এর আওতায় আবার সাড়া দেশজুড়ে খুচরা পণ্য বিক্রয়ের নানাবিধ আয়োজন করে কর্তৃপক্ষটি।
চেংদু শহরও এ পদক্ষেপের আওতায় রাস্তার ধারের পণ্য বিক্রয় কেন্দ্রিক 'নৈশ অর্থনীতির' বিকাশে জোর দিচ্ছে। তাছাড়া, নগর কর্তৃপক্ষ জানান, গত মার্চের পর সেখানে করোনাভাইরাসের নতুন কোনও সংক্রমণও ঘটেনি।
আগামী ১-৮ অক্টোবর চীনের জাতীয় দিবস এবং মধ্য-শরৎ উৎসবের ছুটির সময়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভোক্তাব্যয়কে আরও চাঙ্গা করার-ই সুযোগ নিচ্ছে সেদেশের সরকার।
পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ভোক্তাব্যয়ের অন্যতম সূচক খুচরা পণ্য ক্রয় গত আগস্টে মাত্র শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ে। আগের সাতমাসে এখাতে সংকোচন হয়। তবে অর্থনীতিবিদেরা আগামী মাসগুলোতে ধীরে ধীরে এ ব্যয় বৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
এখাতে কতটুকু অগ্রগতি আসছে তা জানা যাবে খুব শীঘ্রই। আগামী ১৯ অক্টোবর চীনের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা- সেপ্টেম্বর মাসের খুচরা পণ্য বিক্রয় পারফরম্যান্স নিয়ে তথ্য প্রকাশ করবে। তৃতীয় অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের অংশ হিসাবেই এ তথ্য জানা যাবে তখন।
চীনের অর্থনীতি সম্পূর্ণ উত্তরণের পথে একথা এখনই বলার সময় আসেনি। কারণ দেশটির নিম্ন-আয়ের প্রায় ২৯ কোটি পরিযায়ী শ্রমিকেরা মহামারির ছোবেলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন।
এব্যাপারে নোমুরা'র শীর্ষ গবেষক লু তিং জানান, 'চীনের সামগ্রিক অর্থনীতির উত্তরণ এখনও বহুদূরের পথ, বিশেষ করে ভোক্তা চাহিদার ক্ষেত্রে অনেকটা সময় লাগবে।'
জাপানি বিনিয়োগ ব্যাংকটি অনুমান করছে, বছরওয়ারি হিসাবে চলতি সেপ্টেম্বরে চীনের খুচরা বিক্রি ৩ শতাংশ বাড়বে। তবে ২০১৯ সালের গড়পড়তা প্রবৃদ্ধির তুলনায়- তা বেশ কম হবে, বলেই অনুমান করছেন নোমুরা বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, মহামারির পূর্ব সময়ে ২০১৮ সালে চীনের ব্যয় ৮ শতাংশ উচ্চপ্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করেছিল।
- সূত্র: দ্য ডিপ্লোম্যাট, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট