ভারতের ক্রমে বেড়ে চলা কোভিড দুর্দশার জন্য মোদিই দায়ী
সোমবারে প্রায় ৩ লাখ দৈনিক সংক্রমণসহ কোভিডে দেড় হাজার মৃত্যুর কথা জানায় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যেভাবে নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ছে তার ফলে পর্যদুস্ত দেশটির জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে কম দেখানোর অভিযোগ উঠেছে অনেক রাজ্যেই। তবু বাস্তবতার স্বাক্ষী দিচ্ছে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা শ্মশানে জ্বলা একের পর এক চিতার সাড়ি, মর্গে ও শ্মশানে অপেক্ষারত মৃতদের স্বজনদের দীর্ঘ লাইন। হাসপাতালে গেলেই চোখে পড়ছে সদ্য আপনজন হারানোদের বিলাপ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাপ্তাহিক জার্নাল ল্যানসেট সম্প্রতি জানিয়েছে, আগামী জুন নাগাদ ভারতে দৈনিক মৃতের সংখ্যা ২,৩০০ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মহামারিতে সবচেয়ে প্রভাবিত অন্যান্য দেশের মতোই ভারতেও চাইলে এ ট্র্যাজেডি এড়ানো যেতো। সেটি না হওয়ার পেছনে সিংহভাগ দায়ী- একটি দাম্ভিক, আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী এবং অযোগ্য সরকার।
করোনায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত অনেক দেশে ক্ষমতায় আছেন কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিকরা। নরেন্দ্র মোদির মতোই ব্রাজিলের জেইর বলসোনারো, যুক্তরাজ্যের বরিস জনসন, হাঙ্গেরির ভিক্টর ওবান বা ফিলিপাইনের রড্রিগো দুতার্তে এরা সকলেই ডানপন্থী। তারা নিজেদের মহামারি মোকাবিলার ব্যর্থতার জন্য যে রাজনৈতিক পরিণতির সম্মুখীন হবেন, মারাত্মক কিছু ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার পরও মোদিকে হয়তো ততোটা মূল্য দিতে হবে না।
উপরে আলোচিত সব নেতার মতো মোদিও মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়ার বদলে, এর হুমকিকে নগণ্যভাবে উপস্থাপন করতে বেশি সময় ব্যয় করেছেন। গত মার্চে যখন কেস সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছিল তখন ভারত বিশ্বের 'ঔষধাগার' হিসেবে উন্নয়নশীল দেশের চাহিদা মেটানোর মতো সংখ্যায় টিকা উৎপাদন করবে বলে দম্ভ করেন মোদি। তার কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরেক ধাপ এগিয়ে, ভারত মহামারি মোকাবিলার শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলেও দাবি করেন। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকারের লাপড়োয়াভাব ছিল স্পষ্ট।
এর মধ্যে গত মাসে মোদির নামে নামকরণ করা একটি নতুন ক্রিকেট স্টেডিয়ামে প্রায় লাখের কাছাকাছি মানুষ ভারত বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচ দেখতে ভিড় করেন। তার চেয়েও বেশি মানুষ কোনো প্রকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা না নিয়েই পশ্চিমবঙ্গে মোদির নির্বাচনী প্রচারণা ও সমাবেশে যোগ দেন। আবার মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সহকর্মীদের উৎসাহ ও সমর্থনে অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভ মেলা, মহামারির মধ্যেই যাতে অংশ নেন ৩৫ লাখ মানুষ।
ফলাফলস্বরূপ; আকাশছোঁয়া সংক্রমণ বৃদ্ধি আর তার সঙ্গে টিকাদানে দরকারি ডোজের প্রকট সঙ্কটে পড়েছে ভারত। স্থানীয় চাহিদা পূরণে রপ্তানি বন্ধ করা হয় এবং রাশিয়া থেকেও নতুন ভ্যাকসিন আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মেডিকেল অক্সিজেনের মতো মৌলিক সরবরাহ নিয়েও নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে ভারতের একাধিক রাজ্য।
মহামারি নিয়ে ছেলেখেলা করে ক্ষমতা হারানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে নিজের অতি-মানবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দাবি করে বেড়াতেন। মোদির মতো তিনিও মহামারির সবচেয়ে তীব্র সংক্রমণ চলাকালে রাজনৈতিক প্রচারণা বন্ধ রাখতে চাননি। তিনি নিজেকেই মহামারি ব্যবস্থাপনার কৃতিত্ব দিতেন, আবার ভুলত্রুটির দায় চাপাতেন সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজ্য পর্যায়ের নেতৃত্বের উপর, ঠিক এখন যেমন মোদি করছেন।
মহামারি নিয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করায় মার্কিনীরা জো বাইডেনকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। সামান্য ব্যবধানে হলেও হেরে বিদায় নিতে হয় ট্রাম্পকে। কিন্তু তার মতো আরেক নেতা মোদি সম্ভবত রাজনৈতিক বৈতরণে টিকে অহেতুক আরও মৃত্যুর কারণ হবেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প তার পুরো মেয়াদে যতোটা সমর্থন পেয়েছেন তার চাইতেও নরেন্দ্র মোদির গ্রহণযোগ্যতার রেটিংস অনেক বেশি। যেসব ভুল করলে অনেক বিদেশি নেতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শিকেয় উঠতো, তেমন অনেক বিপর্যয় সৃষ্টি করেও মোদি রক্ষা পেয়েছেন। ২০১৬ সালের নোট বদলের সিদ্ধান্ত আর তারপর গেল বছরের অপরিকল্পিত লকডাউনে ১৯৪৭ সালের পর ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অভ্যন্তরীন অভিবাসন সৃষ্টি করেন তিনি। তার সিদ্ধান্তের কারণেই লাখ লাখ পরিযায়ী শ্রমিকের দল অনাহারের মুখে পায়ে হেঁটে বাড়ির পথ ধরে। তবুও যেযাত্রা মোদির জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি।
মোদি এমন এক শক্তির সহায়তা পান, যা কখনোই ট্রাম্প বা বরিস জনসনের মতো নেতারা সব সময় পাননি। এই শক্তি হলো; তার প্রতি সিংহভাগ গণমাধ্যমের অকুণ্ঠ সমর্থন। ভারতজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন করে ব্যাপক বিস্তারের পেছনের অন্যতম কারণই হলো গণমাধ্যমের সহযোগী ভূমিকা। গেল বছরের মার্চেই পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মালিক ও সম্পাদকদের প্রতি ইতিবাচক খবর প্রচারকে গুরুত্ব দেওয়ার অনুরোধ করেন। এব্যাপারে মোদির নিজস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়, " নেতিবাচক মনোভাবের বিস্তার রোধ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গুজবের লাগাম টেনে ধরতেই হবে।"
তবে একথাও ঠিক, মোদি আগে যেসব সঙ্কটের সূচনা করেছেন তার থেকে বর্তমানের সঙ্কট অনেক বেশি ভয়াবহ। পরিণতিটাও গুরুতর হতে পারে। এর আগে, ২০১৯ সালে পাকিস্তানে বিমান হামলা চালিয়ে বহু সন্ত্রাসীকে হত্যা করা বা বাজারে প্রচলিত নোট বাতিলের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করা হয়েছে- তার এমন সব দাবিকে প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ ছিল না। অতীতে তার এসব দাবিকে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে মানুষের মধ্যে প্রচার করেন তার অনুগত সাংবাদিক ও সামাজিক মাধ্যমে সেলিব্রেটির দল।
এবার কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন, ভারতের সুবিধেপ্রাপ্ত ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বিপুল মৃতের সংখ্যাকে মিথ্যে দাবি বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন সঙ্কটকেও অস্বীকার করা যাবে না সহজে। মানুষ যা নিজের চোখেই দেখছে, সেজন্য তাদের গণমাধ্যম নিশ্চিত হওয়ার দরকার নেই। মরীচিকার স্বপ্ন দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে ওস্তাদ খোদ মোদির মতো ব্যক্তিত্বের পক্ষেও এই বাস্তবতাকে উল্টে দেওয়া কঠিন হবে।
- লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলাম লেখক পঙ্কজ মিশ্র। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে- 'এজ অব অ্যাঙ্গার: এ হিস্টোরি অব প্রেজেন্ট,' 'ফ্রম দ্য রুইনস অব এম্পায়ার: দ্য ইন্টেকেলেকচুয়ালস হু রিমেড এশিয়া' এবং 'টেমটেশন্স অব দ্য ওয়েস্ট: হাউ টু বি মডার্ন ইন ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, তিব্বত অ্যান্ড বিয়ন্ড' অন্যতম।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত