ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ কি খাদ্য সংকটের আভাস দিচ্ছে?
ভারতের আকস্মিক পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয় বাংলাদেশের বাজার। এমনকি আটকে পড়ে ইতোমধ্যেই আমদানি মূল্য পরিশোধ করা ট্রাক বোঝাই ছয় হাজার টন পেঁয়াজ। হিলি স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা ট্রাক বোঝাই পেঁয়াজ তীব্র গরমে পচে যাওয়ার দরুণ বড় অংকের ক্ষতি হওয়ার অভিযোগ করেছেন। সবকিছু মিলিয়ে দেশের নাগরিক সমাজে আবারও মিশ্র প্রতিক্রিয়া জন্ম দিল পেঁয়াজ কাণ্ড।
তবে চীনের সমাজতন্ত্রী দলের মুখপত্র ইংরেজি ভাষার দৈনিক গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, এর পেছনে ভারতের নিজস্ব বাজার অবস্থার কারণ থাকতে পারে। দেশটি কী খাদ্য সঙ্কটে পড়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, না অন্যান্য অনুঘটকও কাজ করছে- তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দৈনিকটি। পাঠকের জন্য ওই বিশ্লেষণী প্রতিবেদনের অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো;
কিছুদিন আগেই হঠাৎ করে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু, এখন আবার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে প্রতিবেশী কিছু দেশে ইতোমধ্যেই রপ্তানির জন্য অপেক্ষমাণ চালান ছাড় দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। গত সপ্তাহন্তে (রোববার) এমন সব তথ্য জানা যায় ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে।
পেঁয়াজ সাধারণ ভোক্তাপণ্য; যা দক্ষিণ এশীয় রন্ধনশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই ভারতের হঠাৎ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত- করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন জাগায় বিশেষজ্ঞ মহলে। সস্তা এবং সহজে চাষ করা যায় এমন সবজি পেঁয়াজ- ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীরও খাদ্য তালিকার প্রাত্যহিক অংশ। আর তাই যদি ভারতীয়রাই পেঁয়াজ কিনতে না পারে, তাহলে আগামীতে আরও বড় সমস্যা সামনে অপেক্ষা করছে- এমনটা ভাবা একেবারে অমূলক নয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্র বলছে, পেঁয়াজ উৎপাদনকারী রাজ্যসমূহে বন্যার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় ধ্বস নামে এবং মুল্যস্ফীতি দেখা দেয়। এই দাবি সত্য ধরে নিলে দেখা যায় সরবরাহ ব্যবস্থায় ধ্বসের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অথচ তা আকস্মিক পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে না। রাতারাতি এ সিদ্ধান্ত ভারতীয় পণ্যটি আমদানি নির্ভর দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশকে বিস্মিত করেছে।
নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের মতো দেশগুলিতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার সাথে সাথে ভারত নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে তার সুনামকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। তবে এমন নয় যে, এই প্রথম হঠাৎ করেই পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে ভারত। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরেও পেঁয়াজের উপর অনুরূপ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল দেশটি।
পণ্যের যদি যথেষ্ট উৎপাদন থাকে তাহলে; বাজারে সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ঘাটতি দেখা দিলেও- তা খুব সহজেই একটা সময় স্বাভাবিক অবস্থায় নেমে আসে। তবে স্থানীয় বাজারে উচ্চদর রপ্তানিকে অনুৎসাহিত করে, সেটাও ঠিক।
কিন্তু, সব ব্যাখ্যা ছাপিয়ে যেটা মুখ্য প্রশ্ন হয়ে উঠেছে, তা হলো; পেঁয়াজের সাম্প্রতিক কাণ্ডটি কী বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা? নাকি আসন্ন খাদ্য সরবরাহ সঙ্কটের সূচনা ধ্বনি মাত্র?
বর্তমানে ভারতের অন্যান্য কৃষিপণ্য উৎপাদন নিয়ে তেমন কোনো খবর জানা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় শঙ্কা জাগতেই পারে; অন্যান্য সব ফসল সংগ্রহ কী ইতোমধ্যেই বন্যা এবং করোনাভাইরাস মহামারি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে! কেবলমাত্র ভারত সরকার খোদ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
তারপরও, বাজার সবসময়েই প্রকৃত বাস্তবতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ইঙ্গিত দিতে সক্ষম। দাম বাড়ার অর্থ সরবরাহ সঙ্কট। পেঁয়াজ বা অন্য যেকোনো শস্য; যার বাজারদর জনজীবনকে ব্যাপক প্রভাবিত করে, তার সরবরাহ সঙ্কটের অর্থ; ভারতকে প্রথমে তার নিজ জনগণের খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নাজেহাল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, এই মুহূর্তে স্থানীয় বাজারে খাদ্য সঙ্কট মোকাবিলা করাটাও প্রাধান্য পাচ্ছে। এখানেই ভারতের স্থানীয় বাজার থেকে আসন্ন সঙ্কটের ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
অবশ্য, এমনটাও হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যে, ভারত সরকারের বিশৃঙ্খল সিদ্ধান্ত নেওয়ারই প্রতিচ্ছবি পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা। করোনাভাইরাসের মহামারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া এবং অনিশ্চিত অর্থনীতির প্রেক্ষিতে; জনগণকে পণ্যবাজার নিয়ে আশ্বস্ত করার উদ্যোগ। রপ্তানি বন্ধের পেছনে তাই ভারত জুড়ে ক্রমবর্ধমান উগ্র জাতীয়তাবাদী মনোভাবও কাজ করে থাকতে পারে।
বৈরি এ চেতনা থেকেই অপ্রয়োজনীয় কিছু বিষয়কে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে থাকে ভারত সরকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই ভারত বুঝতে পারে এর ফলে; পাকিস্তান, তুরস্ক এবং চীনের মতো দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় পণ্যটির রপ্তানি বাজারের বিশস্ত সরবরাহকারক হয়ে উঠবে। এসব দেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক উত্তেজনা ও বিরোধের। একারণেই আবার তড়িঘড়ি করে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার আয়োজন চলছে। গতকাল এ সম্পর্কে জানা যায়, দ্য ট্রিবিউনে প্রকাশিত এক সংবাদ সূত্রে।
পরিশেষে, এটা নিশ্চিত যে, ভারতীয় নীতি-নির্ধারকেরা এক তুরুপের তাস দিয়ে সব বাজিমাৎ করতে চান। কিন্তু, কিছু সময় তাদের বাস্তবতা এবং নিজ দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধীরস্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চাও রপ্ত করতে হবে।
- সূত্র: গ্লোবাল টাইমস