ভারত কেন কয়লানির্ভরতা থেকে বেরোতে পারছে না
আর মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হবে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে ধনী দেশগুলো যথারীতি আরো একবার ভারতকে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধের জন্য চাপ দেবে।
সবচেয়ে বেশি গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের তালিকায় ভারত তৃতীয় অবস্থানে আছে। সেইসঙ্গে শিল্পায়ন ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও বাড়াচ্ছে।
কার্বননির্ভর জ্বালানি, বিশেষ করে কয়লার অতি-ব্যবহারের জন্য দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বারবার সমালোচনার শিকার হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশটির ওপর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কমানোর জন্য চাপ আসছে। জলবায়ু সম্মেলনের আগে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের প্রাক-সম্মেলন বৈঠকেও যোগ দেয়নি ভারত। দাওয়াত পাওয়া ৫১টি দেশের মধ্যে একমাত্র ভারতই বৈঠকে অনুপস্থিত থেকেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভারতকে বারবার দায়ী করে আসছে উন্নত বিশ্ব। কিন্তু যেসব মানদণ্ডে উন্নত দেশগুলো ভারতকে দায়ী করছে, সে মানদণ্ডগুলো তারা নিজেদের বেলায় প্রয়োগ করে না। হ্যাঁ, কয়লার ব্যবহার যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু উন্নত দেশগুলো নিজেরা আগে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ না কমিয়ে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কার্বননির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে বলছে। উন্নত দেশগুলোর এই দাবি মোটেই ন্যায়সংগত নয়। এছাড়াও ভারত যদি তড়িঘড়ি করে কয়লানির্ভরতা থেকে সরে আসে, তার ফল হবে ভয়ানক।
ধনী দেশগুলোর ভণ্ডামির সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত পশ্চিমের সবুজ জ্বালানির পোস্টার বয় জার্মানি। দেশটি ২০২১ সালে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর মূল কারণ দেশটির কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি কয়লা পুড়িয়েছে জার্মানি। বর্তমানে দেশটির ২৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে।
পুরনো কিন্তু সত্য একটা কথা ফের বলে নেওয়া দরকার। ভারতীয়রা যে এখনও দরিদ্র, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দেশটির হাতে যথেষ্ট পরিমাণ জ্বালানি নেই। কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষকে দরিদ্রের কাতার থেকে বের করে আনার জন্য বিদ্যুৎ ও পরিচ্ছন্ন জ্বালানি অত্যন্ত জরুরি। ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে দেশটির যেসব রাজ্যে বেশিসংখ্যক স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে, সেসব জায়গায় শিক্ষার হারও বেশি। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকলে রোগী ও নবজাতকের মৃত্যু কম হয়।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের অনুমান অনুসারে, করোনা মহামারির কারণে সাড়ে সাত কোটি ভারতীয় নতুন করে দরিদ্র হয়ে গেছে। ফলে এখন দেশটিতে প্রায় ১৫ কোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারেরও কম।
ভারত বছরে মাত্র ৯৭২ কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ খরচ করে, যা আমেরিকার খরচের মাত্র ৮ শতাংশ এবং জার্মানির ১৪ শতাংশ। ভারতের বাসাবাড়িগুলোতে অধিকাংশ সময়ই লোডশেডিং চলে। বহু দরিদ্র ভারতীয় মাত্র কিছুদিন আগে কাঠ বা গোবর বাদ দিয়ে রান্নার কাজে গ্যাস ব্যবহার শুরু করেছে।
কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার জন্য ভারতের প্রচুর জ্বালানি প্রয়োজন। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির পূর্বাভাস অনুসারে, ২০৪০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জ্বালানির চাহিদা থাকবে ভারতে। চাহিদা মেটানোর জন্য ভারতকে জ্বালানির বিভিন্ন উৎস খুঁজে বের করতে হবে। সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও ভারতের সিংহভাগ জ্বালানির উৎস এখনো কয়লা। দেশটির ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। সে কারণে চলমান কয়লা সংকট দেশটিকে ভালোই ধাক্কা দিয়েছে।
২০২০ সালে ভারত ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা উৎপাদক ও ব্যবহারকারী। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল ইন্ডিয়া বিশ্বের বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যা প্রতিবছর ৬০০ মিলিয়ন টন কয়লা উৎপাদন করে। ভারতের কয়লার রিজার্ভ প্রায় ১০০ বিলিয়ন টন।
জ্বালানি সরবরাহ ছাড়াও কয়লা বহু মানুষের কর্মসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস এবং শিল্পায়নের চালিকাশক্তি। প্রায় ৪০ লাখ ভারতীয় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কয়লা খাতে কাজ করে। কোল ইন্ডিয়াতেই আটটি রাজ্যে ৮৪টি খনিতে প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ কর্মরত রয়েছে। বর্তমান কর্মীরা ছাড়াও আরো পাঁচ লক্ষ ভারতীয় তাদের পেনশনের জন্য কয়লা খাতের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া উন্নত বিশ্বের পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সবুজ শক্তিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়া কতটা ব্যয়বহুল। যুক্তরাষ্ট্রে কয়লা খনি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে গণ-বেকারত্ব দেখা দিয়েছে। চাকরি হারানো কর্মীদের সবুজ শক্তি খাতে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও খুব কমই রাখা হয়েছে। তাছাড়া সবুজ খাতে চাকরির নিরাপত্তা এবং পারিশ্রমিকও অনেক কম।
ভারতীয়দের কাছে কয়লার গুরুত্ব কত বেশি, তা বিশ্বাস করা উন্নত পশ্চিমাদের জন্য কঠিনই হবে। ভারতের ৭৩৬টি জেলার প্রায় ৪০ শতাংশই কোনো-না-কোনোভাবে কয়লার ওপর নির্ভরশীল। কেউ কেউ বর্তমানে কয়লা খাতে কর্মরত, কেউ কেউ কয়লা খাতের পেনশনভোগী।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী দেশগুলোই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেহেতু ধনী দেশগুলোর দায়ই সবচেয়ে বেশি, তাই তাদেরই উচিত সবার আগে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। এর বাইরে অন্য কিছু করা হবে ভণ্ডামি, অনৈতিক এবং অমানবিক।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উন্নত দেশগুলোকে সবার আগে কয়লা ব্যবহার বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছেন, ভারতের মতো দেশগুলোকে নয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলো কয়লানির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেদের সুবিধামতো সময়সীমা নির্ধারণ করছে। ইউরোপের দেশগুলোই জীবাশ্ম জ্বালানি, কয়লা ও এরকম কম পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেদের সুবিধামতো সময়সীমা ঠিক করেছে। তেলের দাম যখন বাড়ছে, তখন বাইডেন প্রশাসন ওপেককে আরো বেশি বেশি তেল উত্তোলনের পরামর্শ দিয়েছে।
ধনী দেশগুলোর ভণ্ডামির সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত পশ্চিমের সবুজ জ্বালানির পোস্টার বয় জার্মানি। দেশটি ২০২১ সালে গত ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। এর মূল কারণ দেশটির কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি কয়লা পুড়িয়েছে জার্মানি। বর্তমানে দেশটির ২৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা থেকে। ২০২২ সালের মধ্যে ৬টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে জার্মানি। ফলে দেশটির কয়লার ব্যবহার আরো বাড়বে। মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য দেশটি একটি কয়লা চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র খুলে দিয়েছে।
উন্নত দেশগুলো যদি এরকম সুবিধা ভোগ করতে পারে, অন্যরা কেন পারবে না?
ভারত ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে নিজেদের লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য হাতে নিয়েছে। কয়লানির্ভরতা থেকে সরে আসার জন্য ধনী দেশগুলো দেশটিকে আর্থিক সহায়তা দিতে পারে।
বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ধনী দেশগুলোই। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যেহেতু ধনী দেশগুলোর দায়ই সবচেয়ে বেশি, তাই তাদেরই উচিত সবার আগে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। এর বাইরে অন্য কিছু করা হবে ভণ্ডামি, অনৈতিক এবং অমানবিক।
- সূত্র: ফরেন পলিসি