ভ্যাকসিনের জন্য ভারতের করুণার উপর নির্ভর করতে হচ্ছে দরিদ্র দেশগুলোকে
ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের ৫০ লাখ ডোজের চালান আসতে দেরি হওয়ায় প্রত্যাশিত গতি থেকে কিছুটা সরে আসে যুক্তরাজ্যের কোভিড টিকা কর্মসূচি। যে দেশটির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম এই টিকা গবেষণা শুরু হয় সেই দেশটিকেই সমস্যায় পড়তে হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে। তার চেয়েও লোহমর্ষক বাস্তবতার মুখে অবশ্য পড়েছে দরিদ্র দেশে বসবাসকারী বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। হঠাৎ করেই তারা জানতে পারলেন- ভারত নিজস্ব জনসংখ্যার মধ্যে জরুরী টিকা চাহিদার কথা উল্লেখ করে রপ্তানি স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তারা অদূর ভবিষ্যতে কোনো টিকাই পাবেন না।
যুক্তরাজ্য টিকাদানের ক্ষেত্রে যে উচ্চ হার অর্জন করেছে, তার স্বত্বেও দেশটি যদি ভারতের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের অভিযোগ তোলে- তা নিতান্তই হাস্যকর শোনাবে। প্রায় ৫০ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক টিকার অন্তত এক ডোজ হলেও পেয়েছেন, সেই তুলনায় ভারতে পেয়েছেন মোট জনসংখ্যার মাত্র ৩ শতাংশ। তাছাড়া, বেশ আগে থেকেই ভারতে উৎপাদিত টিকার বেশ কয়েক মিলিয়ন ডোজের কয়েকটি চালান পেয়েছে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও কানাডার মতো ধনী দেশগুলো। সেই তুলনায় দরিদ্র দেশের প্রাপ্য নিশ্চিত হয়নি।
ভারতে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইসেন্স ওষুধ উৎপাদনকারী শিল্প। টিকা উৎপাদনেও সবার বড় দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটিকে বিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের লাইসেন্স দেওয়া হয় এজন্য যে, তারা যেন সেগুলো ভারতসহ উন্নয়নশীল ও স্বল্প আয়ের অন্যান্য দেশে সরবরাহ করে। এখন সংস্থাটি যে লাখ লাখ ডোজ উৎপাদন করছে, তার সম্পূর্ণ ভাগীদার কিন্তু ভারত একা নয়, বরং সেখানে ন্যায্য হিস্যা আছে বিশ্বের দরিদ্রতম ৯২টি দেশের। সেই অধিকার অস্বীকার করেই ভারত সরকার প্রাণদায়ী এই প্রতিষেধককে শুধুমাত্র ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিশ্ব কীভাবে এই অন্যায়ের শিকার হলো- তা জানতে একটু পিছন ফিরে দেখাও দরকার। এক বছর আগে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তখন করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে বিশ্বের প্রথম সারিতে ছিলেন। সেসময় তারা বলেছিলেন, প্রতিষেধকের কার্যকারিতা প্রমাণিত হলে তারা এটি বিশ্বের যেকোন দেশে যেকোন সংস্থাকে উৎপাদনের সত্ত্ব দেবেন। প্রথমদিকে, যেসব সংস্থা তাদের কাছ থেকে উৎপাদনের অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি করে তারই একটি ছিল সেরাম ইনস্টিটিউট। এক মাস পর বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের পরামর্শ শুনে ব্রিটিশ-সুইস ফার্মা অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে টিকাটি গবেষণা ও উৎপাদনের চুক্তি করে অক্সফোর্ড। ওই চুক্তির বলেই ভ্যাকসিনটির বাজারজাতকরণের সম্পূর্ণ অধিকার পায় অ্যাস্ট্রাজেনেকা। এরপর সংস্থাটি সেরামের সঙ্গে নতুন আরেকটি চুক্তি করে। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন জোট- গ্যাভির সহায়তা পাওয়ার জন্য চিহ্নিত সকল দরিদ্র দেশে সরবরাহের লক্ষ্যে প্রতিষেধকের ডোজ উৎপাদন করবে সেরাম।
গেটস ফাউন্ডেশন এবং ধনী দেশগুলোর অর্থ সহায়তায় গ্যাভির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গ্যাভি ভারতসহ যে ৯২টি দেশকে চিহ্নিত করেছে তাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪শ'কোটি যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। জনসংখ্যা বিবেচনায় এসব দেশের মধ্যে ভারতের ন্যায্য হিস্যা হয় ৩৫ শতাংশ, তবে অ্যাস্ট্রাজেনেকা-সেরাম চুক্তির সময় একটি অলিখিত সমঝোতা হয় দুই পক্ষের মধ্যে, যার আওতায় স্থানীয় চাহিদা পূরণে ৫০ শতাংশ এবং বাকি ৫০ শতাংশ দিয়ে রপ্তানি চাহিদা পূরণের ব্যাপারে উভয়পক্ষ সম্মতি দেয়।
ওই সমঝোতার অধীন আরেকটি শর্তের অধীনে মূল চুক্তিতে উল্লেখ করা গ্যাভির নির্ধারিত দেশসমূহ ছাড়াও অন্য দেশে রপ্তানিতে অনুমতি দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। বিশেষ ওই শর্তের অধীনে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে সেরামের টিকার ডোজ রপ্তানি ছিল নীতিসম্মত। কারণ, এসব দেশের হাতে মহামারি প্রতিরোধে কার্যকর কোনো টিকা তখনও ছিল না। যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো ধনী দেশ নিজ জনসংখ্যার প্রয়োজনের চাইতেও বেশি ডোজ কিনেছে এবং অন্যদের বঞ্চিত করেছে, তাদের ক্ষেত্রে সেরাম উৎপাদিত ও দরিদ্র দেশের জন্য নির্দিষ্ট চালান পাওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার ছিল না। তবুও তারা সেই চালান পেয়েছে।
তার চেয়েও বড় হতবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে, যখন ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতি কোভিড টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব অধিকার অস্থায়ীভাবে তুলে নেওয়ার আহবান জানায়। বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করাসহ আরও ব্যাপক পরিমাণে ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশ দুটি এই আহবান করেছিল, যার ফলে সরবরাহ সঙ্কটের মতো বাঁধা দূর করা সহজ হতো। ওই প্রস্তাবে প্রথমেই যে দেশগুলো বাঁধ সাধে, তারা হলো- যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ব্রাজিল। অথচ, ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এসব দেশের সরকারই ভারতের প্রতি তাদের সরবরাহ সঙ্কট পূরণের দাবি করেছে।
সমস্যা আছে মূল্য নিয়েও। মহামারির মধ্যে বিনা লাভে টিকা বিক্রির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকা। কিন্তু সেরামকে তারা নির্দিষ্ট দরের কোনো সীমারেখা বেধে দেয়নি। যার কারণে আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র দেশ উগান্ডাকে ইউরোপের তুলনায় তিনগুণ দামে প্রতিষেধক কিনতে হয়েছে।
পশ্চিমা ওষুধ শিল্প উন্নত বিশ্বের চাহিদা কোনোরকমে পূরণের সামর্থ্য রাখে- এ চিত্র স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অনেক দেশ ঝুঁকেছে রাশিয়া ও চীনের তৈরি ভ্যাকসিন ক্রয়ের দিকে। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স উদ্যোগ পশ্চিমা কোম্পানিগুলোতে আস্থা রেখে দরিদ্র দেশে সরবরাহের জন্য তাদের সঙ্গেই টিকা সংগ্রহের চুক্তি করে। এসব চুক্তির মধ্যে একমাত্র সংগ্রহের উপযুক্ত ছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিষেধক, যার বৈশ্বিক সরবরাহের সিংহভাগ উৎপাদন করছে সেরাম। আর অল্প কিছু পরিমাণ উৎপাদন করছে দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে বায়োসায়েন্স। একারণেই, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানবতা এই একটি মাত্র ভ্যাকসিনের সরবরাহ পেতে ভারতের এই একটি মাত্র কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
তার সঙ্গে যখন ভারত সরকারের সম্পৃক্ততা আলোচনা করা হয়, তখন সত্যিকারের বিপর্যয় প্রকাশ পায়। পশ্চিমা দেশগুলো বৈষম্য করলেও তারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা গবেষণা ও উন্নয়নের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। সেই তুলনায় ভারত সরকার সেরামের ইনস্টিটিউটের গবেষণায় একটি পয়সা খরচ করেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। অথচ, তারপরও সেরামের টিকার প্রতিটি বৈদেশিক চালানকে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে কৃতিত্ব বাগানোর মহরতে পরিণত করেছেন ভারত সরকারের কর্মকর্তা ও কূটনীতিকরা।
একইসাথে, কোভ্যাক্সে পাঠানো সেরামের প্রতিটি চালানের অনুমোদন দেওয়ার দায়িত্ব নিজেই নিজের কাঁধে লাজশরমের তোয়াক্কা না করে তুলে নিয়েছে ভারত সরকার। সেরামের অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র জানায়, কোভ্যাক্সের আওতায় যাওয়া চালানগুলোয় ডোজের সংখ্যা এবং পাঠানোর দিনক্ষণও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে।
ভারত সরকার তাদের এই ধরনের সম্পৃক্ততার ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি এবং এব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলেও তাতে সাড়া দিতে অসম্মতি জানায়।
গত মাসে দেশজুড়ে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় দেশব্যাপী চলমান টিকাদান কর্মসূচীতে আরও ৩৪৫ মিলিয়ন মানুষকে যুক্ত করার ঘোষণা দেয় ভারত। এ লক্ষ্যে টিকার রপ্তানিতেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয় ভারত সরকার।
কেবল এই ধাপের জন্য ইতোমধ্যে ৬০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়ে গেছে এবং সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে আরও ৬৩০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন।
কোভ্যাক্সিন নামে ভারত বায়োটেকের আরেকটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পেলেও ওই টিকাটি অল্প পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে।
যতো বেশি ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া হবে সেরামের উপর চাপও তত কমবে। এই মুহুর্তে কেবল একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটের উপর বিশাল গুরুদায়িত্ব রয়েছে। তাদের হাতে উপায় আছে দুটো। হয় ৯১টি দেশকে বঞ্চিত করে নিজ দেশ ভারতে টিকাদান কর্মসূচী সফল করা অথবা অন্যদের টিকা দিয়ে নিজ দেশের কর্মসূচী বিলম্বিত করানো।
এর পরিণামও বেশ বিপর্যয়কর। এ পর্যন্ত কোভ্যাক্স কর্মসূচীর জন্য ২৮ মিলিয়ন ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে সেরাম ইনস্টিটিউট যার মধ্যে ১০ মিলিয়ন অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশই রেখে দিয়েছে ভারত। ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চালান গেছে নাইজেরিয়ায়। সেখানে পাঠানো ৪ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন দিয়ে দেশটির মাত্র ১ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা যাবে।
ভারত সরকারের ১০০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডারের কারণে নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোর ভ্যাকসিন পেতে আরও দেরি হবে যা গড়াতে পারে জুলাই পর্যন্ত। আর ভারতের আরও ৫০০ মিলিয়ন ডোজের অর্ডারের কারণে গরীব দেশগুলোতে টিকাদানে এই বিলম্বের মাশুল কী হবে তা এখন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
- লেখকদ্বয়: আঁচল প্রভালা: ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ঔষধে প্রবেশাধিকার বিষয়ে কাজ করা অ্যাকসেস আইবিএসএ এর সমন্বয়ক।
- লীনা মেঙ্ঘানি: ফার্মাসিউটিক্যালস ল বিষয়ে কাজ করা আইনজীবী।
লেখাটি দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত
- অনুবাদ: নূর মাজিদ