মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করেন
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে আর বাকি ৩৩ দিন। নির্বাচনী ডামাডোলে ইতোমধ্যেই উদ্বেলিত দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গন। তবে এরমধ্যেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশটির নাগরিকদের প্রকৃত মনোভাবের প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছে সাম্প্রতিক এক গবেষণা।
তবে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে হলে, আগে নজর দেওয়া দরকার নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রচলিত ব্যবস্থার দিকে। সমর্থনের কিছু, মৌলিক বিষয় এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক দলের অন্ধ-সমর্থনের বৈশ্বিক ধারা বুঝতেও এটি সহায়ক হবে।
যেমন ধরুন, আপনি একজন প্রার্থীকে পছন্দ করেন। কর ব্যবস্থাপনা, পররাষ্ট্রনীতি, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে আপনার মতামতকেই সমর্থন করে তার অবস্থান। একজন ভোটার হিসেবে তিনি আপনার এতটাই আস্থাভাজন যে, নির্দ্বিধায় নিজের বাড়ির চাবি, ইমেইল পাসওয়ার্ড এমনকি নিজের মানিব্যাগটাও তার হাতে তুলে দিতে পারেন।
এখন কল্পনা করুন, আপনার এত পছন্দের সেই রাজনৈতিক নেতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটি কাজ করেছেন। কোনো কারণ ছাড়াই- তিনি বন্ধ করে দিলেন ভোটকেন্দ্র। অথবা রাজনৈতিক সমাবেশে উপস্থিত কোনো সাংবাদিককে শারীরিক আক্রমণের হুমকি দিলেন। এসব ঘটনায় আপনি কি তার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন? ভোট দেবেন বিকল্প প্রার্থীকে!- যিনি গণতান্ত্রিক আচরণকে মেনে চলেছেন।
এই ধরনের তাত্ত্বিক পরিস্থিতি নিয়েই সম্প্রতি আলোচনা করা হয় আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স রিভ্যিউ শীর্ষক জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে। গবেষণা নিবন্ধের লেখক ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাথিউ এইচ. গ্রাহাম এবং মিলান ডব্লিউ. সভোলিক।
এক জরিপের মাধ্যমে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
গণতন্ত্র চর্চা টিকিয়ে রাখতে আপনি আগ্রহী?- সমীক্ষাটিতে এ প্রশ্নের জবাবে প্রায় সব মার্কিন নাগরিক-ই বলেছেন যে; অবশ্যই গণতন্ত্র মূল্যবান এবং তা সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু, তাদের মধ্যে কয়জন অগণতান্ত্রিক আচরণকারী পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেবন- সেটাই ছিল নিবন্ধে মূল আলোচনার বিষয়।
এব্যাপারে গ্রাহাম এবং সভোলিক জানাচ্ছেন, মাত্র ৩.৫% মার্কিন ভোটার সমর্থন প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছেন। বাকিদের কাছে এ প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়নি।
সঠিক তথ্য পাওয়ার লক্ষ্যে বাম ও ডান উভয় ঘরানার মধ্যপন্থী সমর্থক ভোটারদের মধ্যে জরিপটি পরিচালিত হয়। রাজনৈতিক মতবাদের উগ্রতায় তারা কট্টর দলীয় বিভাজনের রাজনীতি দ্বারা কমপ্রভাবিত- এমন অনুমানের ভিত্তিতেই গবেষণায় নমুনা জনসংখ্যা হিসাবে তাদের বেছে নেওয়া হয়।
''সামাজিক ব্যবস্থার কারণে কোনো মার্কিন নাগরিককে গণতন্ত্র পছন্দ করেন কি না- এমন প্রশ্ন করলে 'হ্যাঁ' উত্তরই মিলবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যার বড় কারণ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে এ শিক্ষা পেয়েই তারা বড় হয়েছেন। তাই প্রতি ১০ জনের মধ্যে ১০ জনই- গণতন্ত্র একটি ভালো ব্যবস্থা, বলে মন্তব্য করে থাকেন। সঙ্গে বৈশ্বিক বিষয়াদিও স্থান পায়। যেমন তারা বলেন; পৃথিবীর উষ্ণায়নের লাগাম টেনে ধরা উচিৎ বা তিমিদের রক্ষা করতে হবে। কিন্তু, এত ভালো কথার ভিড়ে গণতন্ত্র নিয়ে তাদের আত্মিক উপলদ্ধি সম্পর্কে জানাটাকেই আমরা প্রাধান্য দেই'' সমাজ বিজ্ঞানীদ্বয় লিখেছেন।
তারা দুজন মোট ১৬৯১ জন মার্কিন ভোটারের মধ্যে জরিপ গবেষণা চালান।
প্রশ্নগুলো ছিল শুরুতে উল্লেখিত আলোচনার মতোই।
যেমন জিজ্ঞাসা করা হয়; আপনি বলছেন গণতন্ত্র একটি ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু, আপনি কী গণতান্ত্রিক চর্চা সমুন্নত রাখার স্বার্থে নিজের পছন্দ ত্যাগ করতে প্রস্তুত? আপনি কী গণতন্ত্র লঙ্ঘনকারী প্রার্থীকে ভোট দেওয়া থেকে দূরে থাকবেন?
এতে কেউ কেউ 'হ্যাঁ' বলেছেন। তবে সেই সংখ্যা আশ্চর্যজনক কম।
সভোলিক জানান, নিজ পছন্দের প্রার্থী থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সম্মতি কেবলমাত্র তখনই দেওয়া হয়, যখন আলোচিত ভোটাররা বিকল্প প্রার্থীর মধ্যে তাদের প্রথমোক্ত প্রার্থীর কিছু বৈশিষ্ট্য দেখতে পান।
এর মানে হলো; দলীয় বিভাজনের নীতি, সিংহভাগ ভোটারকে উৎসাহিত করে অগণতান্ত্রিক আচরণে সমর্থন দিতে। অন্ধ সমর্থনের এ প্রবণতা পারতপক্ষে সমর্থন লাভকারী প্রার্থীর একগুঁয়ে আচরণকেই শক্তিশালী করে। কারণ, ভোটাররা প্রার্থী সম্পর্কে নিজস্ব মূল্যায়নে খুব সামান্যই ছাড় দেওয়ার মনোভাব দেখান।
এভাবে বড় সংখ্যায় দলীয় ভোটার এবং রাজনীতিবিদের উপস্থিতি; গণতান্ত্রিক চর্চা লঙ্ঘনের মাধ্যমে ভোটের রাজনীতিতে সামান্যই শাস্তির সুযোগ সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে। খুব স্বাভাবিক এভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া রাজনীতিক পরবর্তীতে আরও বেশি গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করবেন।
গ্রাহাম এবং সভোলিক তাদের জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে প্রকৃত ঘটনার তুলনাও করেন- মন্টানা রাজ্যের কংগ্রেশনাল বা প্রতিনিধি পরিষদের নির্বাচনী তথ্যের সঙ্গে আলোচনা করে।
ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল; রিপাবলিকান দলের প্রার্থী প্রযুক্তি ব্যবসায়ী গ্রেগ গিয়ানফোর্ট এবং ডেমোক্রেট দলের রব কুইস্টের মধ্যে।
নির্বাচনের মাত্র একদিন আগে ব্রিটিশ দৈনিক- দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক বিন জেকোবস-এর প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করেন গিয়ানফোর্ট। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি জেকোবস-কে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেন।
অবশ্য, ভোটাররা তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন এবং বর্তমানে প্রতিনিধি পরিষদে নিজ রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আগামীতে, তিনি মন্টানার গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন- এমন সম্ভাবনার কথাও শোনা যাচ্ছে।
সাংবাদিকের ওপর হামলার পর- তা স্বীকার করেছিলেন গিয়ানফোর্ট। নির্বাচনের দিন সে সম্পর্কে ভোটাররাও জানতেন, অবশ্য ডাকের মাধ্যমে ভোট দেওয়াদের অধিকাংশ- তা জানতে পারেননি।
বাস্তব জীবনের এ দৃশ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের দেবতুল্য খ্যাতির বিশেষজ্ঞ গ্রাহাম এবং সভোলিকের গবেষণা ফলাফল মিলে যায়।
দেখা গেছে; গিয়ানফোর্টকে সমর্থন দেওয়ার জন্য পূর্ব নিবন্ধিত মাত্র ৩.৬ শতাংশ ভোটার তাকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।
এ থেকে আরও প্রমাণিত হয়; সাংবাদিকের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনা- মার্কিন গণতন্ত্রে দলীয় সমর্থনের বিবেচনায় তেমন গুরুতর অপরাধ নয়।
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক