যেভাবে করোনার বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম সফল
মহামারি করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের সঙ্গে তাদের বিশাল সীমান্ত। জনসংখ্যাও সাড়ে নয় কোটির বেশি। তবুও সেই দেশে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ৩১২ জন। নতুন করে সংক্রমণের কোনো খবরও নেই। প্রাণঘাতী এই রোগে মারা যাননি একজনও। আক্রান্তরাও সবাই সুস্থ হওয়ার পথে। হ্যাঁ, দেশটির নাম ভিয়েতনাম।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির এই দেশটি সম্প্রতি তাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করতে উদ্যোগ নেওয়াও শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির ভয়াল থাবায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ যখন বিপর্যস্ত হয়ে আছে তখন 'দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ' নেওয়ায় ভিয়েতনামকে তেমন কোনো ঝড় পোহাতে হয়নি। তবে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর এখন তাদের কাছে থেকে শিক্ষা নেওয়ার কিছু নেই, কারণ ফুরিয়ে গেছে সময়।
'চরম' মাত্রায় নেওয়া 'বিচক্ষণ' পদক্ষেপ
"যখন এরকম সম্ভাব্য বিপজ্জনক রোগবালাইয়ের সঙ্গে আপনাকে লড়াই করতে হবে তখন, শুরু থেকেই এ বিষয়ে আপনাকে ওভার-রিয়্যাক্ট করতে হবে।"
কথাটি বলেছেন, ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে অবস্থিত হার্ভাড পার্টনারশিপ ফর হেলথ অ্যাডভান্সমেন্ট এর চিকিৎসক ডা. টড পলাক।
ভিয়েতনাম যখনই বুঝতে পেরেছে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ধ্বসিয়ে দেবে, তখনই শুরু থেকেই বড় পরিসরে ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য মাঠে নামে তারা।
জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহানে যখন মাত্র দুজনের মৃত্যু হয় তখনই সতর্ক হয়ে যায় ভিয়েতনাম সরকার।
২৩ জানুয়ারি চীনের উহান থেকে এক ব্যক্তি তার ছেলেকে দেখতে ভিয়েতনামের হো-চি-মিন শহরে আসলে তার কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পর, ভিয়েতনাম সরকার তাদের জরুরি পদক্ষেপগুলো কার্যকর করা শুরু করে।
এ বিষয়ে হো-চি-মিন শহরে অবস্থিত অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চেস ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক গুই থয়েতেস বলেন, "শুরুতে ভিয়েতনাম খুবই এবং খুবই দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। ওইসময়ে ব্যাপারটাকে খুবই এক্সট্রিম মনে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে সবাই বুঝতে পেরেছে এটাই সঠিক ছিলো।"
সংক্রমণ ধরা পড়ার পরপরই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া, সীমান্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাড়ানোসহ যে পদক্ষেপগুলো ভিয়েতনাম তখন নিয়েছিলো অন্যান্য দেশ তা নিয়েছে প্রায় মাসখানেক পর।
নতুন চন্দ্রবর্ষের ছুটি উপলক্ষ্যে সেই যে স্কুলগুলো বন্ধ করা হয়েছিলো তা মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে দেশটির বিশাল শ্রমবাজারে যাতে এই ভাইরাস না ঢুকতে পারে তার জন্য নিয়মিত 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং' করা হয়েছে।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ভিয়েতনামের ফ্রন্টলাইনে কাজ করা অন্যতম চিকিৎসক অধ্যাপক থয়েতেস বলেন, এই দেশটি অতীতে বহুবার মহামারির কবলে পড়েছিলো। এরমধ্যে রয়েছে, ২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ, ২০১০ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ ছাড়াও হাম এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।
তিনি বলেন, "এখানকার সরকার ও জনগণ সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে বরাবরই লড়াই করে বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। সম্ভবত এইসব ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর চেয়েও এখানকার লোকজন বেশি মাত্রায় দক্ষ। তারা জানে, কীভাবে এসবের মোকাবিলা করা যায়।"
মার্চের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে দেশের মধ্যে যারাই প্রবেশ করেছিলো তাদেরকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়েছে ভিয়েতনামের সরকার। এমনকি আক্রান্তদের আশেপাশে যারা গিয়েছিলো তাদেরকেও ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টিনে পাঠায় তারা।
কোয়ারেন্টিনে থাকা লোকজনের থাকার জন্য বিলাসবহুল কোনো ব্যবস্থা না করতে পারলেও ওই সময়ে তাদের থাকা-খাওয়ার সব খরচ জুগিয়েছে দেশটির সরকার।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজ দেশে ফিরে আসা এক নারী বিবিসি ভিয়েতনামিজকে জানান, কোয়ারেন্টিনের প্রথম রাতে তাকে যেখানে রাখা হয় সেখানে কেবলমাত্র একটা মাদুর ছিলো। কোনো বালিশ বা কম্বল কিছুই ছিলো না। পুরো রুমে ছিলো কেবলমাত্র একটি ফ্যান।
অধ্যাপক থয়েতেস বলেন, আক্রান্তদের অর্ধেক ব্যক্তির যখন কোনো উপসর্গই দেখা দিচ্ছিলো না, তখন কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি বেশ কাজে দিয়েছে।
তিনি জানান, কোয়ারেন্টিনে থাকা সবাইকে পরীক্ষা করা হয়েছে। আক্রান্ত ৪০ শতাংশ ব্যাক্তির শরীরে কোনো উপসর্গই ছিল না। পরীক্ষার আগ পর্যন্ত তারা নিজেরাও জানতেন না তাদের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে।
তিনি বলেন, "আপনার দেশে যদি এই পর্যায়ে উপসর্গহীন আক্রান্ত রোগী থাকে তাহলে আপনার সেই কাজটিই করা উচিত যেটি ভিয়েতনাম করেছে।"
"এই লোকগুলোকে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি কোথাও আটকে রাখবেন না, ততোক্ষণ পর্যন্ত এরা ঘুরে ঘুরে ভাইরাস ছড়াতে থাকবে।"