লকডাউন সফল করতে পেটে ভাত থাকা চাই
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে গোটা ভারতে চলছে লকডাউন। কিন্তু এই পথে সমাধান না মেলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দেশটির নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন।
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারতে অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে অনাহারে মৃত্যু বাড়বে। অসংখ্য মানুষের চাকরি যাবে। ধীরে ধীরে খাদ্যের সঙ্কট তৈরি হবে। ভারতে যার পরিণতি হবে অত্যন্ত মারাত্মক এবং ভয়াবহ।
ড. অমর্ত্য সেন আরও বলেন, কেউ যখন ভাবছেন কী করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচা যাবে, কেউ তখন ভাবছেন, কোথায় দুটো ভাত পাওয়া যাবে! কাজেই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
তার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন নোবেলজয়ী আরেক ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ড. অভিজিৎ ব্যানার্জি। খাবারের খোঁজে মানুষ রাস্তায় বের হতে বাধ্য হলে লকডাউনের সুফল পাওয়া যাবে না বলে অভিমত তার। খবর আজকাল ও ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যমের।
চলমান করোনা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অভিজিৎ ব্যানার্জি বলেন, গোটা দেশে লকডাউনের সিদ্ধান্ত সফল করতে হলে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতে হবে। তা না হলে মানুষ শুধু খাবারের খোঁজেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে! শুধু রেশন বা বিনামূল্যে খাবার দিলেই হবে না। তাদের আরও কিছু চাহিদা থাকে। সেগুলোও যেন তারা পূরণ করতে পারেন, তার পরিসর তৈরি করে দিতে হবে। তাদের হাতে এমন কিছু তুলে দিতে হবে যেন তারা এই লকডাউনের সময়ে প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করেন।
নোবেলজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ এস্তার দুফলোও একই অভিমত প্রকাশ করেছেন। ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বললেন, তিন সপ্তাহ পরও যদি মানুষের হাতে টাকা না থাকে, খাবার না থাকে, মানুষকে ঘরে আটকে রাখা মুশকিল হয়ে যাবে। তার ফলে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করতে যে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটি ব্যর্থ হবে। আর এই পরিস্থিতিতে মানুষ যদি ঘর থেকে বেরতে শুরু করে, তাহলে সমস্যা আরও বাড়বে।
অভিজিৎ ব্যানার্জির গবেষণা ও জীবনসঙ্গী এস্তার দুফলো আরও বলেন, লকডাউন অবশ্যই জরুরি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তখনই সফল হবে, যখন তা মানুষের প্রাণরক্ষা করতে পারবে। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে যদি দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে হয়, সেক্ষেত্রে এখন থেকে তার প্রস্তুতি নিতে হবে।
এদিকে লকডাউনের শুরু থেকেই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। এই মনোভাবের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অমর্ত্য সেন বলেছেন, ভারতের মতো দেশ যেখানে মানুষের মধ্যে এত বৈচিত্র, এত মতামত, যেখানে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন রকমের চাহিদা, সেখানে এই পরিস্থিতিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করার কোনো মানেই হয় না। কিছু মানুষ শুধুই ভাবছেন, কীভাবে করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্যদিকে কিছু মানুষ শুধু দু'মুঠো ভাতের সন্ধান করছেন। চিন্তা করছেন, পরের দিনও খাবার জুটবে তো?
ড. সেন আরও বলেন, এই লকডাউনের সময়ে মানুষ যদি কর্মসংস্থান হারাতে থাকে, তাহলে রোজগারের সব রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষের হাতে টাকা থাকবে না। তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যেখানে দেখা যাবে, শেষে খাদ্যের অভাবে মানুষকে মরতে হচ্ছে। এটা এমন একটা পরিস্থিতি, যেখানে আমাদের আরও সহযোগী হয়ে উঠতে হবে।
অন্যদিকে, ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু সাবধান করে দিয়ে বলেন, 'অনেকেই বলছেন, এই মুহূর্তে আমাদের শুধুই করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করতে হবে। অর্থনীতি নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আমি বলব, এটা একেবারেই ভুল ধারণা। করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকার যদি দেশের অর্থনীতির বিষয়টি এড়িয়ে যায়, সেক্ষেত্রে তার মাশুল গুণতে হবে সাধারণ মানুষকেই। যার পরিণাম ভয়ঙ্কর।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু আরও বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারত সরকার শুরুতেই বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, এ কথা সত্য। কিন্তু তাতেও বেশকিছু সমস্যা থেকে গিয়েছে। কিন্তু যেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, অর্থনীতির বিষয়টি সবসময়েই মাথায় রাখতে হবে। ডলারের তুলনায় রুপির দাম যদি ক্রমাগত পড়তে থাকলে দেশের অর্থনীতি সত্যিই ধ্বসে পড়বে।
তিনি বলেন, যদি দেশের অর্থনীতি ধ্বসে যায়, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। ইতিহাস তার সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়। সুতরাং, করোনাভাইরাস মোকাবিলা নাকি দেশের অর্থনীতি- প্রশ্ন এটা নয়? বরং প্রশ্ন হলো, কীভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পথ দেখানো সম্ভব?