স্পেসএক্সের ড্রাগন ক্যাপসুলে চড়ে মহাকাশে পাড়ি জমালেন শখের নভোচারীরা
ফ্লোরিডা থেকে ব্যক্তিগত মিশনে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছেন চার নভোচারী। মিশনটির নাম দেওয়া হয়েছে ইনস্পিরেশন-৪।
ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্সের তৈরি নভোযান 'স্পেসএক্স ড্রাগন' এ চড়ে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করেছেন এই অপেশাদার নভোচারীরা। তাদের মধ্যে একজন ধনকুবের রয়েছেন; আর তার সঙ্গী হিসেবে রয়েছেন তিনজন 'সাধারণ নাগরিক'।
এই চারজন আগামী তিনদিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবেন।
তাদের এই ভ্রমণ মহাকাশ পর্যটনের বাজারে আরেকটি নতুন মাইলফলক তৈরি করলো।
কিছুদিন আগেই যুক্তরাজ্যের বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন এবং তারই অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী জেফ বেজোস তাদের নিজস্ব মহাকাশযানে চেপে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করেছিলেন।
এই মিশনের ধারাবাহিকতায়, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) আরো দুটি ব্যক্তিগত সফর হতে চলেছে আগামী কয়েক মাসে। প্রথমটি হবে চলতি বছরের অক্টোবরে; সেই মিশনের যাত্রী হবেন একজন রাশিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক ও একজন অভিনেত্রী। আর দ্বিতীয় সফরটির সময় নির্ধারণ করা হয়েছে নতুন বছরের প্রথম দিকে।
এদিকে ইন্সপিরেশন-৪ এর চার নভোচারী জ্যারেড আইজ্যাকম্যান, হেইলি আর্সেনউক্স, সিয়ান প্রক্টর এবং ক্রিস সেমব্রস্কি স্পেসএক্স থেকে ছয় মাসের নিবিড় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
অনবোর্ড কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে তাদের ড্রাগন ক্যাপসুলের নিয়ন্ত্রণ করা হবে। অর্থাৎ, স্পেসএক্স সেন্টার গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ড্রাগন ক্যাপসুলটির তত্ত্বাবধানে থাকবে।
নভোযানটি ৫৭৫ কিলোমিটার উচ্চতায় উঠবে। অর্থাৎ, ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (আইএসএস) থেকে ১৫০ কিলোমিটার ওপরে উঠবে ড্রাগন।
স্পেসএক্স নভোচারীদের এই অস্থায়ী আবাসে গম্বুজাকৃতির এক বিশাল কাচের জানালা বসিয়েছে, যেখান থেকে নভোচারীরা নিচের দিকে তাকালেই পৃথিবীকে দেখতে পাবেন।
ইন্সপিরেশন-৪ মিশনের নেতা, ৩৮ বছর বয়সী মার্কিন ধনকুবের জ্যারেড আইজ্যাকম্যান একটি ক্রেডিট কার্ড কোম্পানির প্রধান নির্বাহী। নিজের বন্ধুদের সঙ্গে মহাকাশ ভ্রমণের আনন্দ ভাগাভাগি না করে, বরং তিনি মহাকাশ অভিযানের জন্য এমন তিনজনকে তার সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছেন, যাদের জীবনে কোন না কোন অনুপ্রেরণামূলক গল্প রয়েছে।
আইজ্যাকম্যানের অন্য তিন সঙ্গীর মধ্যে একজন হলেন, ২৯ বছর বয়সী হেইলি আর্সেনউক্স। তিনি শিশু বয়সে হাড়ের ক্যান্সারকে জয় করেছিলেন এবং বড় হওয়ার পর এখন মেমফিসের সেই সেইন্ট জুড চিলড্রেন রিসার্চ হাসপাতালে ফিরে অন্যদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দিচ্ছেন। এই হাসপাতালের চিকিৎসায়ই তিনি সুস্থ হয়েছিলেন। আইজাকম্যান সেন্ট জুডের জন্য ২০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে চান।
ইনস্পিরেশন-৪ এর আরেক পর্যটক ৫১ বছর বয়সী ভূবিজ্ঞানী ড. সিয়ান প্রক্টর। ২০০৯ সালে নাসার নভোচারী হওয়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু বাছাইপর্বের একেবারে চূড়ান্ত রাউন্ডে বাদ পড়ে যান। শিল্পী ও উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের দক্ষতা দেখিয়ে, এই ভ্রমণে আইজ্যাকম্যানের সফরসঙ্গী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। ড্রাগনের গম্বুজাকৃতির জানালায় তাকিয়ে পৃথিবী দেখার সময় ছবি আঁকার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
আইজ্যাকম্যানের তৃতীয় ও সর্বশেষ সফরসঙ্গী ৪২ বছর বয়সী ক্রিস সেমব্রস্কি। মার্কিন বিমান বাহিনীর সাবেক এই সদস্য এখন মহাকাশ কোম্পানি লকহিড মার্টিনে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছেন। সেইন্ট জুডে অনুদান দেওয়ার সুবাদে লটারির মাধ্যমে ইনস্পিরেশন-৪ মিশনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন তিনি।
সেমব্রস্কি কিন্তু লটারি জিততে পারেননি। তবে তার একজন বন্ধু জিতেছিলেন এবং নিজে সরে গিয়ে বন্ধু সেমব্রস্কিকে মহাকাশ ভ্রমণের সুযোগ করে দেন তিনি।
স্পেসএক্স বুধবার স্থানীয় সময় রাত ৮টায় প্রথমবারের মতো একটি 'অল-সিভিলিয়ান মিশন ইন অরবিট' বা সম্পূর্ণ বেসামরিক মানুষদের নিয়ে অভিযান চালু করল। এখানে 'বেসামরিক' কথাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাপোলো-১১ তে চড়ে চাঁদে পদার্পণকারী প্রথম ব্যক্তি নীল আর্মস্ট্রং, মূলত একজন বেসামরিক মানুষই ছিলেন। এর নয় বছর আগে, ১৯৬০ সালে তিনি নৌবাহিনীর কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তবে এতে কোন সন্দেহ নেই, বর্তমান মহাকাশ পর্যটন বাজারে আইজ্যাকম্যানের ড্রাগন ফ্লাইটের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
মহাকাশ ভ্রমণ দিনে দিনে বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে। এবং মানুষ যে পৃথিবীর কক্ষপথের বাইরেও পা রাখতে পারে, সেই ধারণা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে!
চলতি শতাব্দীর একদম শুরুতে, বেশ কয়েকজন ধনকুবের মহাকাশ পর্যটকের দেখা মিলেছিল। তবে মহাকাশ পর্যটনের সেই বিশেষ যুগ শেষ হয়ে যায় ২০০৯ সালে, যখন রাশিয়ার রকেটগুলোর অতিরিক্ত আসন নাসা মহাকাশচারীদের একচেটিয়া ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছিল।
তবে ধারণা করা হচ্ছে, এই দ্বিতীয় যুগটি হবে আরো স্থায়ী এবং প্রাণবন্ত। কারণ এখন অনেক বেসরকারি মহাকাশ কোম্পানিও ব্যবসায়ের পেছনে ছুটছে এবং গ্রাহকদের জন্য মহাকাশ ভ্রমণের খরচ আরো কমিয়ে আনার কথা চিন্তা করছে।
মহাকাশ ভ্রমণের ব্যাপারে আইজ্যাক বলেন, "আমরা কিছু সময়ের জন্য মহাকাশ স্টেশনে (৪২০ কিলোমিটার) যাচ্ছি, এবং এখানে বিজ্ঞান ও গবেষণার দুর্দান্ত অবদান রয়েছে। কিন্তু যদি আমরা আবার চাঁদে কিংবা মঙ্গল গ্রহে বা এর বাইরে যেতে চাই, তাহলে আমাদের 'কম্ফোর্ট জোন' থেকে বেরিয়ে এসে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। সুতরাং, আমরা ভ্রমণের জন্য যে উচ্চতায় উঠতে চাচ্ছি সেটি যুক্তিসঙ্গত।"
তবে কয়েকজন মন্তব্যকারী এই জাতীয় মহাকাশযানের মাধ্যমে পৃথিবীর জলবায়ুতে কী ধরণের প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটে জ্বালানি হিসেবে অতি-পরিশোধিত কেরোসিন ব্যবহৃত হয়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস কার্বন-ডাইঅক্সাইড উৎপাদন করে। এছাড়া, এই রকেট নাইট্রোজেন অক্সাইডও নিঃসরণ করে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়াতে অবদান রাখে।
- সূত্র- বিবিসি