এত কম খরচে ভারত কীভাবে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে পৌঁছাল?
ভারত সম্প্রতি মহাকাশে অভিযান পরিচালনায় ২.৭ বিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রজেক্ট ঘোষণা করেছে। চন্দ্র জয়ের পর এবার এটি ভবিষ্যতের জন্য খরচ করা হবে। এর অংশ হিসেবে রয়েছে শুক্র গ্রহে মহাকাশযান পাঠানো, দেশটির প্রথম মহাকাশ স্টেশনের প্রথম পর্যায়ের নির্মাণ ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য পুনরায় ব্যবহারযোগ্য রকেটের উন্নতির মতো বিষয়। খবর বিবিসির।
ভারতের মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এটিই এককভাবে সর্বোচ্চ বরাদ্দ। তবে এতে বিদ্যমান প্রজেক্টগুলোর জটিলতা ও পরিসর বিবেচনায় অর্থের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। এতে করে কম খরচে মহাকাশ অভিযানের দিক থেকে দেশটির নাম আরও একবার আলোচিত হচ্ছে।
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) এতো স্বল্প খরচে চাঁদ কিংবা মঙ্গলে অভিযান পরিকল্পনা করেছে যে, এতে বিশেষজ্ঞরাও অভিভূত। সংস্থাটি মঙ্গলযানের জন্য ৭৪ মিলিয়ন আর চন্দ্রযান-৩ এর জন্য মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। অপরদিকে নাসার ম্যাভেন তৈরিতে খরচ হয়েছিল ৫৮২ মিলিয়ন ও চাঁদের ভূপৃষ্ঠে ধ্বংস হওয়া রাশিয়ার লুনা-২৫ যানের পেছনে খরচ হয়েছে ১৩৩ মিলিয়ন ডলার।
খরচ কম সত্ত্বেও বিজ্ঞানীদের মতে মহাকাশ যাত্রায় ভারত বেশ অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছে। চন্দ্রযান-১ সর্বপ্রথম চাঁদের মাটিতে পানির উপস্থিতি নিশ্চিত করেছিল। আর মঙ্গলযান মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের অবস্থা নির্ণয়ে একটি পেলোড বহন করেছিল। একইসাথে চন্দ্রনাথ-৩ এর প্রেরণকৃত ছবি ও ডেটা প্রবল আগ্রহ নিয়ে মহাকাশ অনুরাগীরা পর্যবেক্ষণ করেছে।
ইসরোর ফাইনান্স সেকশনে প্রায় দুই দশক ধরে দায়িত্বে থাকা সাবেক কর্মকর্তা শিশির কুমার দাস জানান, ১৯৬০-এর দশকে সর্বপ্রথম সরকারের কাছে মহাকাশ যাত্রায় জন্য পরিকল্পনা জমা দেওয়া হয়। তখন থেকেই ব্যয় সংকোচনের দিকে সংস্থাটি গুরুত্ব দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে বিশাল আয়তনের এই দেশটি নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই বেশ হিমশিম খায়।
শিশির কুমার দাস বলেন, "ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানী বিক্রম শারাভাই সরকারকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, ভারতের মতো গরীব দেশে মহাকাশ প্রোগ্রাম একতরফাভাবে শুধু কঠিন ব্যয়বহুল বিষয়ই এমনটা নয়। বরং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকেরা আরও সুবিধা পেতে পারেন।"
এক্ষেত্রে দেশটির আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় ভারত সবসময়ই বেশ কম বাজেটের মধ্যে নিজেদের মহাকাশ প্রোগ্রামগুলো চালিয়েছেন। ১৯৬০ ও ৭০ দশকের ছবি থেকে দেখা যায়, বিজ্ঞানীরা সাইকেল কিংবা গরুর গাড়িতে করে রকেট ও স্যাটেলাইট স্থানান্তর করছে।
দশকের পর দশক পার হয়ে গেলেও, বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করলেও ইসরোর বাজেট খুব একটা বাড়েনি। চলতি বছর সরকারের পক্ষ থেকে মহাকাশ প্রোগ্রামে ১.৫৫ বিলিয়ন বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে চলতি বছর নাসার বাজেট ২৫ বিলিয়ন ডলার।
শিশির কুমার দাস মনে করেন, ইসরোর মিশনগুলো সাশ্রয়ী হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে এতে ব্যবহৃত সকল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি।
১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা করলে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে প্রযুক্তি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। মহাকাশ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে এটি বরং এক আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়।
শিশির কুমার দাস বলেন, "আমাদের বিজ্ঞানীরা এটিকে নিজস্ব প্রযুক্তি বিকাশের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম দেশীয়ভাবে তৈরি শুরু হয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের বেতন ও খরচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের তুলনায় বেশ কম ছিল।"
বিজ্ঞান লেখক পল্লবা বাগলা বলেন, "নাসা স্যাটেলাইট তৈরির ক্ষেত্রে প্রাইভেট কোম্পানির সহযোগিতা নিয়ে থাকে। একইসাথে মিশনের জন্য ইন্সুরেন্সের সহযোগিতাও নেন। যাতে করে খরচ বেড়ে যায়।"
তিনি বলেন, "অন্যদিকে ভারত নাসার মতো এমন ইঞ্জিনিয়ারিং মডেল ব্যবহার করে না যা ফাইনাল লঞ্চের আগে পরীক্ষামূলকভাবে লঞ্চ করে দেখতে হয়। আমরা শুধুমাত্র একটি একক মডেল করি এবং এটিই উৎক্ষেপণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটা ঝুঁকিপূর্ণ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সেই ঝুঁকিটা আমরা নিই। আমরা এটি নিতে সক্ষম কারণ এটি একটি সরকারি প্রোগ্রাম।"
ভারতের প্রথম ও দ্বিতীয় মঙ্গলযাত্রার প্রধান মাইলস্বামী আন্নাদুরাই বলেন, "ইসরোর কর্মকর্তার সংখ্যা সীমিত। একইসাথে তাদের বেতনও তুলনামূলক কম। এতে করে প্রজেক্টগুলো বেশ সাশ্রয়ী হয়।"
আন্নাদুরাই জানান, তিনি ১০ সদস্যেরও কম সংখ্যক কর্মকর্তা নিয়ে কাজ করতেন। কখনো কখনো ওভারটাইমেও কাজ করতেন কোনো ধরনের অতিরিক্ত বেতন ছাড়াই। কেননা তারা নিজেদের কাজের প্রতি আগ্রহী ছিলেন।
সাশ্রয়ী বাজেটের কারণে অনেক সময় প্রকৌশলীর নিজেদের পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হতো। এতে করে নতুন নতুন বিষয়ের উদ্ভাবনও হয়েছে।
আন্নাদুরাই বলেন, "চন্দ্রযান ১ এর জন্য বাজেটের পরিমাণ ছিল ৮৯ মিলিয়ন ডলার। মূল ভিত্তির জন্য এটি ঠিকঠাক বরাদ্দই ছিল। কিন্তু কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যে, মহাকাশযানটি চাঁদে বাড়তি অনুসন্ধান চালাবে; যাতে এর ভর আরও ৩৫ কেজি বেড়ে যাবে।"
এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের নিকট দুটি অপশন ছিল। এক, মিশনের জন্য আরও ভারী রকেট তৈরি করা। কিন্তু এতে খরচ আরও বেড়ে যেত। অন্যদিকে কিছু হার্ডওয়্যার সরিয়ে এর ওজন আরও কমানো।
আন্নাদুরাই বলেন, "আমরা দ্বিতীয় অপশনটি বেছে নেই। এক্ষেত্রে থ্রাস্টারের সংখ্যা ১৬ থেকে কমিয়ে আটে নামিয়ে আনা হয়। আর প্রেশার ট্যাঙ্ক ও ব্যাটারি দুটি থেকে কমিয়ে একটি করা হয়।"
মঙ্গলযানের ক্ষেত্রে আরও কম অর্থ খরচ হয়। আন্নাদুরাই জানান, ঐ সময়ে চন্দ্রযান-২ এর জন্য বেশিরভাগ হার্ডওয়্যার ডিজাইন করে ফেলা হয়েছিল; যেটি পরবর্তীতে বিলম্বিত হয়েছিল। তাই সে সকল হার্ডওয়্যার ডিজাইন মঙ্গলযানে ব্যবহার করা হয়েছিল।
বাগলা মনে করেন, ভারতীয় মহাকাশ প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী নীতি বেশ প্রশংসার দাবি রাখে। তবে দেশটি যেহেতু এক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত করছে, তাই এতে বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
বর্তমানে ভারত অপেক্ষাকৃত ছোট রকেট লঞ্চার ব্যবহার করছে। কেননা এরচেয়ে শক্তিশালী লঞ্চার তাদের নেই। এতে করে দেশটির মহাকাশযানগুলি গন্তব্যে পৌঁছাতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নিচ্ছে।
বাগলা জানান, ভারত ২০৪০ সালের মধ্যে চাঁদে একটি মনুষ্যবাহী মিশন পরিচালনার পরিকল্পনা করছে। সেখানে নভোচারীদের দ্রুত পৌঁছাতে আরও শক্তিশালী রকেটের প্রয়োজন হবে।
ভারত সরকার জানায়, নতুন এই রকেট তৈরির কাজ ইতোমধ্যেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ২০৩২ সালের মধ্যে যা তৈরি হবে। পরবর্তী প্রজন্মের উপযোগী এই লঞ্চিং রকেটটি আরও বেশি ভর বহনে সক্ষম হবে; একইসাথে খরচও বেশি হবে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান