এশিয়ায় চীনের নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করবে আরসেপ চুক্তি
এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতিগুলোর বন্ধনকে আরো জোরদার রূপ দিয়েছে- 'রিজিওনাল কম্প্রেহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসেপ) শীর্ষক চুক্তির বাস্তবায়ন। ফলে গত শনিবার (১ জানুয়ারি) নতুন বছর শুরুর দিনেই আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্তবাণিজ্য জোট, যার মূল উদ্যোক্তাই চীন। এতে এশীয় শক্তিটির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বিস্ময়করভাবে বাড়বে বলে ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা।
চীনের এ সফলতায় উদ্বেগ দেখাচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। যেমন ফ্রান্স-২৪ এর প্রতিবেদনে আরসেপ'কে 'চীনা অভ্যুত্থান' বলে অভিহিত করা হয়েছে। কথাটি মোটেই বাড়িয়ে বলা হয়নি, কারণ চীনের আমদানি (কাঁচামাল, যন্ত্রাংশ ও ভোগ্যপণ্য) বাজারের বিশাল চাহিদার সাথেই এ চুক্তি যুক্ত করেছে অন্য দেশগুলোকে।
২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে এশিয়ার বাদবাকি দেশ থেকে চীনে রপ্তানি বেড়েছে ২৬০ শতাংশ। প্রধান কোনো অর্থনীতির বাজারে যা সর্বোচ্চ সম্প্রসারণের ঘটনা। তাছাড়া, মহামারিজনিত মন্দা থেকে চীনের পুনরুদ্ধার শীর্ষ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সবার আগে শুরু হওয়ায়; দেশটিতে আগামীদিনে রপ্তানি বাজার আরো বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
আমদানি চাহিদাকে শক্তিতে পরিণত করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাবলয় গড়ে তুলতে সেকারণেই সফল হয়েছে বেইজিং। তাছাড়া, প্রতিবেশী দেশগুলোর বিপুল পরিমাণ পণ্য ও কাঁচামাল গ্রহণের যে সক্ষমতা ও ইচ্ছে চীনের রয়েছে- সেটাই তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। চুক্তিতে আবদ্ধ দেশগুলোও সুবিশাল এই রপ্তানি বাজারকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি।
চুক্তিটির সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে জাতিসংঘের বাণিজ্য সহায়ক সংস্থা আঙ্কটাড বলেছে, আরসেপ আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্যকে ৪২ বিলিয়ন ডলার বাড়াবে।
আরসেপ চুক্তিতে সই করেছে ১৫টি এশীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। অতিবাহিত সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে আমদানি বাণিজ্যের শুল্ক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমবে। বলাই বাহুল্য, শুল্ক বাধা দূর হয়ে চীনের বিশাল বাজারেও আরো রপ্তানি বাড়বে জোট-সহযোগীদের।
দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের ১০ সদস্য দেশ- মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়াসহ আরসেপে যুক্ত হয়েছে- চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
জোটের দেশগুলো বৈশ্বিক জিডিপির ৩০ শতাংশ বা ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের প্রতিনিধিত্ব করে। এই বিশাল ভোক্তাবাজারের মোট জনসংখ্যা ২২০ কোটি, যা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ।
সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডার (ইউএসএমসিএ) ত্রিপাক্ষিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বিশ্ব বাণিজ্যের মাত্র ২৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। আরও ছোট বা ১৮ শতাংশ হলো- ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক বাজার ব্যবস্থা।
চীন পুরো বিশ্বের উৎপাদন কেন্দ্র হওয়ায়, দেশটিতে কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি নেহাত কম নয়। উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রাংশ, মাইক্রোচিপসহ জ্বালানি, ধাতুর আকরিক ইত্যাদি বিপুল পরিমাণে আমদানি করে থাকে সেগুলো রপ্তানি পণ্যে পুনর্ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। আবার ক্রমবর্ধমান সম্পন্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রয়েছে নানান ভোগ্যপণ্যের চাহিদা। সব মিলিয়ে এশীয় দেশগুলোর আন্তঃবাণিজ্যের মধ্যমণি চীন, আরসেপেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র।
ভূ-রাজনীতিতে আরসেপ:
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের তিক্ততা বেড়েছে চীনের। অভিযোগ রয়েছে, ভূ-রাজনীতির লক্ষ্য অর্জনে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে ব্যবহার করেছে বেইজিং। কিন্তু, এসব শঙ্কা এবং চীনের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধিতা সত্ত্বেও গেল বছরের জুনে আরসেপ- এ সই করে জাপান। চীন এ জোটের নেতৃত্ব দেবে জেনেও চুক্তিটি করেছে টোকিও।
পশ্চিমা বলয়ের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়াও যেন তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিক বন্ধন দৃঢ় করলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব রোধের সামরিক তৎপরতাতেও যোগ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অস্ট্রেলিয়ার পরমাণু সাবমেরিন চুক্তি 'অকাস' এর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই নীতি বেইজিং এর পক্ষেই যাবে। কারণ অর্থনীতির দৃঢ় বন্ধন থাকলে ভূ-রাজনীতিতে কোনো দেশের সাথে বৈরিতা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এবং প্রতিপক্ষ দেশের রাজনৈতিক প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না।
আরসেপ-কে তাই চীনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ বলছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কৌশল যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলকে টেক্কা দেবে নিঃসন্দেহে।
সিঙ্গাপুরের একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ও দেশটির জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সম্মানীয় ফেলো কিশোর মাহবুবানি ফরেন পলিসিতে লেখা এক নিবন্ধে এমন বিশ্লেষণই তুলে ধরেন।
তিনি বলেছেন, ভারত ও প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলে বেইজিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হলো প্রতিবেশীদের সাথে বাণিজ্যে জোরদান।
তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র অকাস নিরাপত্তা চুক্তির ওপর বাজি ধরেছে। যা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণু শক্তিচালিত সাবমেরিন সরবরাহের অঙ্গীকারের ওপর।
মাহবুবানির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশল দীর্ঘমেয়াদে ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সে তুলনায় অর্থনীতির দাবার চালে এগিয়ে যাবে বেইজিং।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে আসিয়ান জোটের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেওয়ায় সে সময়ে তুঙ্গে ছিল ভিয়েতনাম ও আসিয়ান জোটের মধ্যেকার বৈরিতা ও অবিশ্বাস। কিন্তু, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর আসিয়ানের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বলয়ে যোগ দিয়ে ভিয়েতনাম সেই সম্পর্কের নাটকীয় উন্নতি ঘটিয়েছে।
এই কথাটি চীনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। প্রতিবেশীদের সাথে বেইজিংয়ের সম্পর্কোন্নয়নে আরসেপ সে সুযোগই এনে দেবে। ফলে সামরিক উপস্থিতি যতই বাড়ানো হোক- দিনশেষে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য তাতে বিপন্ন হবে।
- সূত্র: এশিয়া টাইমস, ফরেন পলিসি, ডয়চে ভেলে