যেভাবে পুতিনকে বুঝতে ভুল করেছে পশ্চিমারা
পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের মিত্ররা ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে। কিন্তু, রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আগেভাগে সাবধান করেননি এমন দাবিও করার সুযোগ নেই তাদের।
আজ থেকে ১৫ বছর আগেই সোভিয়েত গুপ্তচর সংস্থা-কেজিবির এ সাবেক কর্মকর্তা স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। মার্কিন আধিপত্যকে পুতিন রাশিয়ার প্রতি হুমকি হিসেবেই উল্লেখ করেছিলেন।
এরপরের বছরগুলোয় তিনি সেনাবাহিনী পাঠিয়ে প্রতিবেশী জর্জিয়ার একাংশ দখলে নিয়েছেন, দখল করেছেন ক্রিমিয়া, এমনকি সেনা সদস্যদের গোপনে মোতায়েন করেন ইউক্রেনে রুশভাষাভাষী অধ্যুষিত ডনবাস অঞ্চলে।
পুতিন তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দেন যে, তিনি রাশিয়ার প্রভাব বলয় আরও বিস্তারে আগ্রহী। একইসাথে, থামাতে চান ন্যাটো জোটের পূবমুখী সম্প্রসারণ। ন্যাটোকে তিনি সব সময়েই রাশিয়ার নিরাপত্তার প্রতি চিরন্তন হুমকি হিসেবে দেখেছেন। ইউক্রেনে অভিযানের আগেই তিনি দাবি করেন, দেশটি রাশিয়ারই অংশ।
এত কিছুর পরও পুতিন পুরোদমে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেবেন তা অতি-সাম্প্রতিক সময়ের আগে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশের সরকার প্রধানই বিশ্বাস করেননি। প্রয়োজনে পুতিন যে কতখানি দৃঢ়তার সাথে শক্তিপ্রয়োগ করতে পারেন- তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন তারা। অথচ ইউক্রেনে পুতিনের অভিযান ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
গত বুধবার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। আর গতকাল শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) থেকে স্থল ও আকাশথে অভিযান চালাচ্ছে দেশটির রাজধানী কিয়েভ দখলের।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র জানান, মস্কো আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে ইউক্রেনকে "অসামরিকীকরণের" লক্ষ্যে পরিচালিত যুদ্ধাভিযান অব্যাহত থাকবে।
আগেভাগে পশ্চিমাদের পুতিনকে না বুঝে ওঠার বিষয়ে মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক তিন তারকা মর্যাদার জেনারেল এইচ. আর. ম্যাকমাস্টার বলেন, "রাশিয়ার কৌশলগত আত্মমগ্নতা পুতিন ও তার সহযোগীদের চালিত করে- এর সাথে জড়িত আবেগকে সঠিক গুরুত্ব না দেওয়াই পশ্চিমা শক্তিগুলোর ব্যর্থতার বড় কারণ।"
একথার মাধ্যমে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টার শুধু পুতিন নয়, বরং তার শীর্ষ পরামর্শদাতাদের একান্ত মনোভাবের দিকেও ইঙ্গিত দেন।
ইউক্রেনে পুতিনের সর্বাত্মক আক্রমণ পশ্চিমা বিশ্বকে অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলেছে। ক্রেমলিনের আগ্রাসন ঠেকানোর কার্যকর উপায় ভাবতেই দিশেহারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের প্রভাবশালী দেশগুলো। প্রকাশ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা ও যুদ্ধংদেহী স্বভাবের পুতিনকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়- তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। আগ্রাসী পুতিনের সাথে সঠিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়াও তারা আগে থেকে ঠিক করতে পারেনি।
পশ্চিমা বিশ্বের এই প্রস্তুতির অভাবে আজ খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন। কারণ গত ১৪ বছর ধরে দেশটির কৌশলগত অবস্থান নির্ণয় করা হয়নি। দেশটিকে ন্যাটো সদস্য করার জন্য চিহ্নিত করা হলেও, কখনোই সদস্যপদ দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তার বিষয়ে কিয়েভকে দেওয়া সকল প্রতিশ্রুতিও ভঙ্গ করা হয়েছে।
পশ্চিমা জোটের সাথে গত এক দশকে বরফশীতল সম্পর্ক ছিল রাশিয়ার। ইউক্রেনে আগ্রাসন যা শেষপর্যন্ত আরও দীর্ঘমেয়াদী করে তুললো। কূটনীতির সুযোগ কমিয়ে, বাড়িয়ে দিল ব্যবধান।
তাই ইউক্রেন সংকটের সমাধানও এখন অনিশ্চিত। নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পুতিন যে মোটেই বিচলিত নন, সেকথা খোদ পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে আসছে। তবে কী পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা পুতিনকে এক কণাও বুঝতে পারেননি- নাকি পুতিন সব গোপনে গোপনে করেছেন? সব দেখেশুনে এসব প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু, না—রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে পুতিন রাখঢাক করেননি। ২০০৮ সালে জর্জিয়াকে ন্যাটো সদস্যপদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই দেশটিতে আগ্রাসন চালানো হয়। জর্জিয়া থেকে দুটি বিচ্ছিন্নতাকামী অঞ্চলকেও 'স্বাধীন' দেশের স্বীকৃতি দেয় ক্রেমলিন।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মস্কোর সাথে সব সংলাপ কিছুদিন বন্ধ রাখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন। কিন্তু কিছুকাল পরই উবে যায় সে কঠোর অবস্থান। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর তেমনিভাবেই রাশিয়ার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, কিন্তু সেসবে পাত্তাই দেননি পুতিন।
গত কয়েক মাসে গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কৌশল প্রকাশ করেন। তাদের আশা ছিল, আক্রমণের প্রস্তুতি ফাঁস হওয়ায় দমে যাবেন পুতিন। কিন্তু, তারা পুতিনকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন। আগের মার্কিন প্রশাসনগুলোও একই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
এব্যাপারে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। বুশ বলেছিলেন, তাকে (পুতিন) দেখে আমার মনে হয়েছে তিনি বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।
পুতিনকে গুরুত্বের সাথে নেননি বুশের উত্তরসূরী বারাক ওবামাও। কৃষ্ণাঙ্গ এ প্রেসিডেন্ট রাশিয়াকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে মেনে নেননি। ওবামা বলেছিলেন, পুতিনের রাশিয়া নিজ দুর্বলতা থেকেই প্রতিবেশীদের হুমকি দিচ্ছে।
কিন্তু, ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়া বিরোধী জোট সবচেয়ে দুর্বল করেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্প ইউরোপের মিত্রদের রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সামরিক ব্যয়কে ক্রেমলিনের চেয়েও বড় আপদ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইউরোপের মিত্ররা ট্রাম্প আমলে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা অনেকটাই হারিয়ে ফেলে। জো বাইডেন ন্যাটো জোটের সেই ভগ্নতরীর হাল ধরেন। গেল জুনে পুতিনের সাথে এক সম্মেলনে 'স্থিতিশীল ও অনুমান করা যায়' এমন সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতিও দেন।
কিন্তু, সব আশাবাদ দিনশেষে উবে গেছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইউরোপের দেশগুলোর দোষও স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে। তারা নিজেদের সামরিক বাহিনীর আকার কমিয়েছে, একইসাথে জ্বালানির জন্য রাশিয়া নির্ভরতা কমাতে খুব সামান্যই কাজ করেছে।
পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে ধারাবাহিক সাইবার হামলাসহ রাশিয়ার অন্যান্য আগ্রাসী আচরণ সত্ত্বেও তারা দ্বিচারীতা বন্ধ করেনি। একদিকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে, আরেকদিকে রাশিয়ার গ্যাস কিনে মস্কোর হাতে তুলে দিয়েছে কাঁড়ি কাঁড়ি ইউরো।
ফলে পুতিন আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। তিনি ইউক্রেনের জনগণকে আজ মানবিক বিপর্যয়ে ফেলেছেন, দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করছেন। ইউরোপকেও এজন্য চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও দিতে পারে মাথা হেঁট করার কৌশলগত মূল্য। আর ওয়াশিংটনের ভয়টা সেখানেই।
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল