ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগে নীরবে শত শত কোটি ডলার কামাচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতের বড় কোম্পানিগুলো
ভাবা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে যারা বোমা ও শেলের আঘাতে নরহত্যাকে মহৎ মিশনের নাম দিয়েছে, তেল সম্পদ লুঠে যারা যুদ্ধ করেছে—তারা আজ রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার। কথা হচ্ছে, পশ্চিমা গণমাধ্যম ও জনমত নিয়ে।
ইউক্রেনের পক্ষে তাদের সমর্থন স্বঘোষিত, আর তাতে কোনো রাখঢাকও নেই।
পশ্চিমা দুনিয়া চায় ইউক্রেন লড়ে যাক, ক্ষয় হোক রাশিয়ার রণশক্তি। তাদের আশা, ইউক্রেনে সামরিক বিপর্যয় টলাবে পুতিনের গদি। সেজন্য ন্যাটো ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন কিয়েভকে অস্ত্র সহযোগিতা দিচ্ছে গোপনে। যুদ্ধের কল্যাণে তাই ফুলেফেঁপে উঠছে ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যায়নের পশ্চিমা প্রতিরক্ষা শিল্প খাত। ইউরোপ ও আমেরিকা, আটলান্টিকের দুপাশের শিল্পেই চলছে আরও কতো লাভ হবে; সে হিসাব-নিকাশ।
যুদ্ধের কারণে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে। ইউক্রেনকে দেওয়া সহায়তা এবং নিজস্ব বাড়তি চাহিদা-দুইয়ে মিলেই রমরমা হয়ে উঠছে অস্ত্রের বাজার।
যেমন ইউক্রেনে পাঠাতে এরমধ্যেই ৪৫ কোটি ইউরোর অস্ত্র কেনার ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। গেল বছর ইউক্রেনকে ৬৫ কোটি ডলারের অস্ত্র-সরঞ্জাম দিয়েছে আমেরিকা। যুদ্ধ শুরুর পর করেছে বাড়তি ৩৫ কোটি ডলার সামরিক সহায়তার অঙ্গীকার।
ন্যাটো ও আমেরিকা মিলিতভাবে এপর্যন্ত ১৭ হাজার ট্যাংক-বিধ্বংসী অস্ত্র এবং ২ হাজার বিমান-বিধ্বংসী কাঁধে বহনযোগ্য স্ট্রিংগার মিসাইল ইউক্রেনে পাঠিয়েছে। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক ও কানাডার মতো কয়েকটি দেশ আন্তর্জাতিকভাবে জোটবদ্ধ হয়েও ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ যুদ্ধকে সশস্ত্র করতে চাইছে।
এসব ঘোষণা বিশ্বের বৃহৎ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের ঠিকাদার বা প্রস্তুতকারক কোম্পানির জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদ। যেমন, মার্কিন প্রতিরক্ষা জায়ান্ট রেথিওন স্ট্রিংগার মিসাইলের প্রস্তুতকারক, আরেক জায়ান্ট লকহিড মার্টিনের পণ্য জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাংক মিসাইল। ইউক্রেনে এই মিসাইলটি আমেরিকা ও এস্তোনিয়ার মতো দেশ সহায়তা হিসেবে পাঠাচ্ছে।
ব্যবসার সুদিন বুঝেই প্রতিরক্ষা গ্রুপ দুটির শেয়ার দর বেড়েছে পুঁজিবাজারে; ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর লকহিড আর রেথিওনের বাজারমূল্য বেড়েছে যথাক্রমে ১৬ ও ৩ শতাংশ। অথচ এ সময়ে আমেরিকার শীর্ষ ৫০০ কোম্পানির বাজারসূচক এসঅ্যান্ডপি-৫০০ এর সার্বিক অবনতি ছিল ১ শতাংশ।
ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের অস্ত্র বাজারের সবচেয়ে বড় কোম্পানি বিএই সিস্টেমসের বাজারমূল্য বেড়েছে ২৬ শতাংশ। অন্যদিকে, বিশ্বের সেরা ৫টি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহক কোম্পানির মধ্যে কেবল বোয়িংয়ের বাজারদরই কমেছে, যার প্রধান কারণ অবশ্য তাদের বেসামরিক উড়োজাহাজ বিক্রিবাট্টায় মন্দা।
সুযোগের হাতছানি
যুদ্ধ শুরুর আগেই পশ্চিমা সমরাস্ত্র কোম্পানিগুলো তাদের বিনিয়োগকারীদের ব্রিফিং করেছে। এসময়, তারা সামনে মুনাফা আরও বাড়বে বলে জানায়।
গত ২৫ জানুয়ারি কোম্পানির আয়ের বিষয়ে এক বৈঠকে রেথিওনের প্রধান নির্বাহী (সিইও) গ্রেগরি জে হায়েস বলেন, "পূর্ব ইউরোপে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার দিকে, দক্ষিণ চীন সাগরের উত্তেজনার দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। গত এক সপ্তাহ ধরেই অঞ্চল দুটি অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাতে সরকারগুলোর ওপর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতির কিছুটা সুফল আমরা পাব বলেই আশা করছি।"
ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা শিল্প ২০২২ সালে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে এমন আভাস দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের কারণে সে আভাসের চেয়ে বেশি বিকশিত হতে পারে অস্ত্র বিকিকিনির ব্যবসা।
এবিষয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতের বাজার পরামর্শক সংস্থা- অ্যারোডাইনামিক অ্যাডভাইজরির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রিচার্ড আবৌলাফিয়া বলেছেন, "এই সংঘাত রাশিয়ার জন্য তাসের ঘর বলেই মনে হচ্ছে, হঠাৎ যুদ্ধ থেমে যাওয়াই এখন বিনিয়োগকারীদের একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ।"
তবে তেমন কোনো লক্ষণই আপাতত দেখা যাচ্ছে না। আর তাতে নানানভাবে উপকৃত হচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতের কোম্পানিগুলো। সরাসরি অস্ত্র বিক্রি তো আছেই—তার সাথে জার্মানি ও ডেনমার্কের মতো ধনী দেশের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণায় সামনে আরও সুদিনের আলো দেখছে।
সামরিক শিল্পে বিশ্ব নেতৃত্ব আমেরিকার হাতে। ২০১৬-২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার ৩৭ শতাংশ করেছে আমেরিকা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা রাশিয়ার অবদান ২০ শতাংশ। এরপর যথাক্রমে রয়েছে ফ্রান্স (৮%), জার্মানি(৬%) ও চীন (৫%)।
এই শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের বাইরে বাজারের অপেক্ষাকৃত ছোট খেলোয়াড়রাও এ যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে। যেমন রাশিয়ার হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে ইউক্রেনের কাছে উচ্চ প্রযুক্তির ড্রোন বিক্রি করেছে তুরস্ক। বর্তমানে দেশটি বৈশ্বিক সমরাস্ত্র বাজারে ১ শতাংশ অবদান রাখছে। যুদ্ধের কল্যাণে জোরালো প্রবৃদ্ধির মুখ দেখছে আঙ্কারার নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প।
অস্ত্র বিক্রিতে ৩ শতাংশ অবদান আছে ইসরায়েলের। সম্প্রতি দেশটির একটি সংবাদপত্র হারেৎজে প্রকাশিত এক সংবাদের শিরোনাম ছিল এ রকম, "রুশ আগ্রাসনের প্রথম দিকের বিজয়ী: ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা শিল্প।"
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ ও আমেরিকা, যা মোকাবিলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম ও উপকরণ রপ্তানি কমায় মস্কো। আর বাড়িয়ে দেয় সেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের প্রচেষ্টা। রুশ সরকার বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিপুল ভর্তুকি দিয়ে সহায়তার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করে। একইসঙ্গে, বিদেশের বাজারে সমরাস্ত্র বিক্রি বাড়াতেও অনেকটা সফল হয়।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক হিসেবে রাশিয়ার অস্ত্রের অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেশ রয়েছে। তবে প্রধান ক্রেতা দেশ ভারতে ৫৩ শতাংশ বিক্রি কমায় ২০১৬-২০ সালে অবশ্য রাশিয়ার রপ্তানি ২২ শতাংশ কমেছিল। তবে ওই একইসময়ে চীন, আলজেরিয়া এবং মিশরের কাছে মস্কোর অস্ত্র বিক্রি নাটকীয় হারে বাড়ে।
মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, "পশ্চিমা অস্ত্রের তুলনায় রাশিয়ার সমরাস্ত্র দামে কম হলেও পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ সহজ।"
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা কোম্পানির মধ্যে রয়েছে, মিসাইল প্রস্তুতকারক আলমাজ- আন্তেই ২০১৬-২০ মেয়াদে তাদের মোট বিক্রি- ৬৬০ কোটি ডলার। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে- ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট কর্প (৪৬০ কোটি ডলার) এবং ইউনাইটেড শিপবিল্ডিং কর্প (৪৫০ কোটি ডলার)।
-
পিটার ব্লুম: ইউনিভার্সিটি অভ এসেক্সের ম্যানেজমেন্ট-এর অধ্যাপক