তেল বেচাকেনায় সৌদি আরব ও চীন কেন ডলার বাদ দিতে চায়?
জ্বালানি তেলের মূল্য হিসেবে চীনা মুদ্রা ইউয়ান নেওয়ার পরিকল্পনা করছে সৌদি আরব। চুক্তি বাস্তবায়িত হলে চীন এখন নিজেদের মুদ্রার মাধ্যমেই সৌদির সঙ্গে লেনদেন করতে পারবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের জন্য সৃষ্টি হয়েছে অস্বস্তিকর এক মুহূর্তের।
শুধু সৌদি আরবেই নয়, সারা বিশ্বেই ইউয়ানের মাধ্যমে বৈদেশিক লেনদেন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে চীন। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে চীন ডলারের মাধ্যমে সৌদি আরবের কাছ থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে আসছে। সম্প্রতি দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তেলের জন্য সৌদি আরব ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেনের আলোচনা করেছে।
ডলার নির্ভরতা কমিয়ে আনলে বিশ্বে ডলারের দাম কমবে। ফলে সৌদি ও চীন দুটো দেশই উপকৃত হবে ফলে মনে করেন বোস্টন কলেজের সহকারী ডিন এবং অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আলেকজান্ডার টমিক।
ইনসাইডারের কাছে তিনি বলেন, "চীন কেবল একাই নয়, অনেক দেশই ডলারের বিকল্প রিজার্ভ মুদ্রা খুঁজছে।" তার মতে, ডলার ভিত্তিক লেনদেনের কারণে দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে, আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, ইউয়ানের এই চুক্তি তেমন কোনো পরিবর্তন আনবে না। সৌদি রিয়ালের মান ডলারের বিনিময় হার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেকোনো অস্থির অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে সৌদিকে সুরক্ষা দেয় এই ডলার পেগ।
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার পর বিভিন্ন দেশ ডলার নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ডলার বিরোধিতার কারণে দেশগুলোর ওয়াশিংটনের ক্ষোভের মুখে পড়াও আশঙ্কাও মাথায় রাখছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ টমিক।
তিনি বলেন, "ইউয়ানের মাধ্যমে লেনদেনের সম্ভাব্য চুক্তি থেকে ধারণা করা যায়, ইউএস ডলারের একটি শক্তিশালী বিকল্প খুঁজছে বিশ্ব।"
ইউয়ানের মাধ্যমে তেলের চুক্তি করার পিছে সৌদি আরবের উদ্দেশ্য হলো ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের জন্য একটি সুরক্ষা বেষ্টনী নির্মাণ। আরেকটি কারণ হলো সৌদি আরব ডলারের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকটাই সন্দিহান। আর্থিক প্রতিকূলতা মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র উদার হাতে অর্থ সরবরাহ বজায় রাখলে সেই শঙ্কা বাস্তবে রূপ নেওয়াও অসম্ভব নয় বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
অন্যদিকে, চীনও দীর্ঘসময় ধরে ডলারের পরিবর্তে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করে আসছে। রাশিয়ার প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক লেনদেন থেকে বাদ পড়ায় চীনের সুযোগ এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। টমিকের মতে, ইউয়ানের প্রভাব বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যদি চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করে, তারপরও চীনের পক্ষে তা মোকাবেলা করা কঠিন হবে না।
তবে ইউয়ানের অন্যতম রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে ওঠার জন্য দুটি জিনিস ঘটা প্রয়োজন। প্রথমত, ডলারের বিশ্বস্ততা নষ্ট হতে হবে। আর এটা সম্ভব হবে যদি ফেডারেল রিজার্ভ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় অথবা হুট করে অস্বাভাবিক কিছু ঘটে।
দ্বিতীয়ত, অন্যান্য দেশের বিশ্বস্ততা অর্জনে চীনকে ইউয়ানের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার প্রমাণ দিতে হবে। কিন্তু চীন রপ্তানি বাড়াতে প্রায়ই মুদ্রার ডিভ্যালুয়েশন বা মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে আনা কৌশল অবলম্বন করে থাকে। অথচ কোনো দেশই এমন একটি মুদ্রা ব্যবহার করতে চাইবে না। আর তাই চীনকে আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মুদ্রানীতি নির্ধারণ করতে হবে।
তবে এতকিছুর পরেও চীন বৈশ্বিকভাবে ইউয়ানের লেনদেন বাড়ানোর স্বপ্ন দেখে। সম্ভবত আফ্রিকাতেই চীন সবচেয়ে সফলভাবে ডলারের জায়গা দখল করে নিতে পারবে বলে মনে করেন টমিক। আফ্রিকা মহাদেশের অর্থনীতিতে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ঋণদাতা ও বিদেশি বিনিয়োগকারী বৃহত্তম দেশ চীন।
এছাড়া, আফ্রিকায় ইতোমধ্যে চীনের উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো রয়েছে। ইউরোপের মতো এখানকার বাজার তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণও নয়।
তবে আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের বিকল্প হতে হলে চীনকে এমন সময় বেছে নিতে হবে, যখন ডলারের পতন নিশ্চিত।
যদি যুক্তরাষ্ট্র অপ্রত্যাশিত কিছু না করে, তাহলে অন্যান্য দেশও ডলারের ওপর ভরসা বজায় রাখবে বলে মনে করেন টমিক। তার মতে, "ডলার এর আগেও প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু তারপরও অন্য কেউ তার জায়গা দখল করতে পারেনি, কেননা যখন অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র স্থিতিশীল থাকে। আর এভাবেই আধিপত্য বজায় রাখে ডলার।"
- সূত্র: মার্কেট ইনসাইডার