আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ কেন পুতিনকে নীরব সমর্থন দিচ্ছে?
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ নিয়ে জাতিসংঘে পুতিনকে নিরব সমর্থন দিয়ে চলেছে আফ্রিকার স্বৈরাচারী মিত্ররা।
পশ্চিমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় বুধবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রশিয়া-বিরোধী প্রস্তাবে ১৪১টি দেশ ইউক্রেন "আগ্রাসনের" বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়ে ভোট দেয়।
প্রস্তাবে রাশিয়াকে "আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানার মধ্যে ইউক্রেনের ভূখণ্ড থেকে অবিলম্বে, সম্পূর্ণভাবে ও নিঃশর্তে সমস্ত সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করার" আহ্বান জানানো হয়েছে।
উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ, সিরিয়া ও ইরিত্রিয়া কেবল এই চারটি দেশ রাশিয়াকে সমর্থন জানিয়েছে। বিশ্বের স্বৈরাচারী কোনঠাসা গুটিকয়েক রাষ্ট্রের পুতিনের পক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়টি খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। পুতিন আন্তর্জাতিকভাবে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে এটা তারই লক্ষণ। তবে যে দেশগুলো কোনো ধরনের অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত ছিল তাদের তালিকা আরও কৌতূহলোদ্দীপক।
৩৫টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই চীন ও ভারতের নাম আছে। ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) কারণে মস্কোর সঙ্গে দেশ দুটোর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভোটদানে বিরত অর্ধেক দেশই ছিল আফ্রিকার।
আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশ অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় উপনিবেশায়নের ভয়াবহতা ও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে অবগত। আর তাই আফ্রিকার ভূরাজনীতি সম্পর্কে জানেন না এমন যে কেউ ইউক্রেনে রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আচরণ নিয়ে ১৭টি আফ্রিকান দেশ কেন নিন্দা জানাল না, তা দেখে অবাক হতে পারে। এছাড়াও সাতটি আফ্রিকান দেশ ভোটে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
আফ্রিকার বেশ কিছু আঞ্চলিক সংস্থা ও দেশ অবশ্য এই আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং পশ্চিম আফ্রিকার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংস্থা ইকোয়াস উভয়ই আঞ্চলিক পর্যায়ে আগ্রাসনের নিন্দা জানায়। আফ্রিকার প্রতিনিধিত্বকারী তিন দেশ কেনিয়া, গ্যাবন ও ঘানাও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিন্দা জানিয়েছে।
কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ যারা বর্ণবাদের পতনের পর বিশ্বের নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো নিয়ে গর্ব করে, তারা কেন বেসামরিক এলাকায় ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের পরেও রাশিয়াকে নিন্দা জানাতে চাইছে না?
কয়েক দশক ধরে যুদ্ধবিধ্বস্ত সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকই (সিএআর) বা কেন এই সহিংসতার নিন্দা জানানো থেকে বিরত রয়েছে রয়েছে?
এর কোনো একক উত্তর নেই। তবে ভোটদানে বিরত থাকার বিষয়টি থেকেই দেখা যায় যে আফ্রিকার স্বৈরাচারী সরকারগুলোর ওপর মস্কোর কূটনৈতিক প্রভাব এখনও কত প্রবল।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বহু দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে মস্কো। এসব দেশের উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেকেই মস্কো থেকে পড়াশোনা করেছেন এমনকি রাশিয়ান ভাষাতেও বেশ সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন। তবে সোভিয়েত পরবর্তী সময়ে এই সম্পর্ক অনেকটাই মিইয়ে যায়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃত রাশিয়ার সামরিক প্রভাব। আফ্রিকার অর্ধেকের বেশি দেশের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে। আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে অস্ত্রের বৃহত্তম রপ্তানিকারক রাশিয়া।
আলজেরিয়া, উগান্ডা, বুরুন্ডি, দক্ষিণ সুদান, মালি, মোজাম্বিক, সুদান এবং অ্যাঙ্গোলার মতো দেশগুলো বুধবার ভোটদান থেকে বিরত ছিল। দেশগুলো রাশিয়ার সামরিক হার্ডওয়্যার এবং বন্দুকের ওপর খুব বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল। এই দেশগুলোর সবই স্বৈরাচারী বা একনায়কতান্ত্রিক। নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে দেশগুলো বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন নয়।
উগান্ডায় ৩৫ বছর ধরে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতির প্রভাবশালী সন্তান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহুজি কাইনেরুগাবা টুইটারে পুতিনের আক্রমণের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করে বলেন– "অধিকাংশ মানবজাতি (যারা অশ্বেতাঙ্গ) ইউক্রেনে রাশিয়ার অবস্থান সমর্থন করে।
কাইনেরুগাবা পূর্ব আফ্রিকার জনমতের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক তুলে ধরেন। এখানে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, আফ্রিকা মহাদেশে এবং সাম্প্রতিক সময়ে লিবিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে পশ্চিমা আগ্রাসনের বিপরীতে ইউক্রেনে পুতিনের আক্রমণ ন্যায়সঙ্গত।
মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, সুদান, সিএআর এবং মালির মতো বেশ কয়েকটি দেশ রাশিয়া থেকে ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ দিয়ে থাকে। রাশিয়ার স্বনিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী 'ওয়াগনার গ্রুপ' থেকে এখনও অস্ত্রধারী সেনা ভাড়া রেখেছে অনেকেই। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়েই খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ ও যুদ্ধপরাধের মতো অভিযোগ রয়েছে।
ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নথি অনুসারে, রাশিয়ার সৈন্যরা ২০১৬ সাল থেকে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জিম্বাবুয়ে এবং বুরুন্ডিতে সক্রিয়। কোনো দেশেই ভোটগ্রহণ হয়নি।
সুদানের শীর্ষ যোদ্ধা ও ডেপুটি লিডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ হামদান হেমেতি আক্রমণ শুরুর সময় রাশিয়ায় ছিলেন। হেমেতির সৈন্যদের ওয়াগনার গ্রুপের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ সমর্থন করে হেমেতি বলেন, রাশিয়ার আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স থিঙ্ক ট্যাঙ্কের স্টিভেন গ্রুজড সম্প্রতি সিএনবিসিকে বলেন, "যেসব দেশে রাশিয়ার বড় ধরনের উপস্থিতি রয়েছে, বিশেষ করে যারা রাশিয়ার বেসরকারি সামরিক সেনাদের ভাড়া করে রেখেছে, তাদের কাছ থেকে কঠোর নিন্দা আশা করবেন না।"
তবে ধারণা করা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, সেনেগাল এবং নামিবিয়া সংঘাতে একটি জোটনিরপেক্ষ অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছে। ব্রিকসের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা মস্কোকে নাখোশ না করতে সতর্ক।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক বিবৃতিতে জাতিসংঘে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থায়ী প্রতিনিধি মাথু জয়িনি "কূটনীতি ও সংলাপের" আহ্বান জানিয়ে "সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান"-এর ওপর জোর দিয়েছেন। তবে রাশিয়াকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা থেকে বিরত ছিলেন জয়িনি।
তিনি বলেন, "আমরা সকল পক্ষকে মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলার পাশাপাশি সমঝোতার ইচ্ছা নিয়ে পরিস্থিতি সমাধানের আহ্বান জানাই।"
এদিকে ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার অবস্থান প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রয়াত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুকে উদ্ধৃত করে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই বলেন- "আপনি যদি অন্যায়ের পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ হন তবে আপনি নিপীড়কের পক্ষ বেছে নিয়েছেন।"
তবে আফ্রিকার অর্থনীতির আরেক শক্তিশালী দেশ নাইজেরিয়া ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় দেশটি বিরক্ত। এই অঞ্চলটি নাইজেরিয়া ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র মনে করে।
ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর ওপর পশ্চিমা অনেক কূটনীতিকই ক্ষুদ্ধ। তবে আক্রমণের বিষয়ে তাদের অবস্থান যাই হোক না কেন, আফ্রিকার দেশগুলো আবারও দেখিয়েছে যে পশ্চিমা বিশ্বে তাদের হেলার চোখে দেখার সুযোগ নেই। উন্নত বিশ্বের মতো গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণের নেতারাও তাদের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম এবং তারা সেই অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিবে।
- সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা