‘তুরুপের তাস’ গোপন চিঠিতে নয়, ইমরানের শেষরক্ষা হতে পারে ‘মিরাকলে’
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট জাতীয় পরিষদের নিম্নকক্ষে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। ভোটাভুটি হতে পারে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। তার আগে ২৭ মার্চের এক জনসমাবেশে ইমরান তার সরকারকে 'বিদেশি একটি শক্তি' হুমকি দিয়েছে বলে জানান। এরপর গত বুধবার (৩০ মার্চ) সেই বহুল-আলোচিত চিঠির গোপন কথাগুলি জানিয়েছেন পাকিস্তানের শীর্ষ সাংবাদিকদের।
৩০ মার্চেই তার ভাগ্যাকাশে ঘটে গেছে নাটকীয় পরিবর্তন। পিটিআই জোট সরকার থেকে পদত্যাগ করে ইমরানবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোটে যোগ দিয়েছে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)। এতে জাতীয় পরিষদে সম্মিলিত বিরোধী জোটের আসনসংখ্যা ১৭৭টিতে পৌঁছেছে। অনাস্থা প্রস্তাব পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ আইনপ্রণেতার সমর্থন। অর্থাৎ দরকারের চেয়ে পাঁচটি বেশি ভোট এখন বিরোধীদের হাতে।
সুযোগসন্ধানী এমকিউএম:
পাকিস্তানের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ডন এক বিশ্লেষণে বলেছে, কঠিন সময়ে যখন 'জাতির ভালোর জন্য', এমন তকমা দিয়ে একদল পক্ষ বদল করে, তখন নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ হওয়া অনেকটাই স্বাভাবিক বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।
এক্ষেত্রে পাকিস্তানের এমকিউএমের উদাহরণ খুবই প্রাসঙ্গিক। সংকটের সময়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত ছেড়েছে এই দল। শুধু তা-ই নয়, সরকার দলের অংশীদার এমকিউএম জোট থেকে বেরিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গেও চুক্তি করেছে।
তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুবিধাজনক সময়ে 'পাকিস্তানের স্বার্থের জন্য' তকমা দিয়ে এমকিউএমের এমন পক্ষ পরিবর্তন কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়।
পাকিস্তানী সংবাদমাধ্যম ডনের একটি সম্পাদকীয়র তথ্যানুসারে, ১৯৮৮ সাল থেকেই দলটি বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি সরকারের সঙ্গেই নিজেদের সুবিধামতো তাল মিলিয়ে এসেছে।
তবে গত কয়েক দিনে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ইস্যুতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যা ঘটেছে তা প্রমাণ করে যে, দেশটির প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নিজেদের উদ্দেশ্য উদ্ধারে 'নোংরা' রাজনীতির চর্চা করতে দ্বিধা করে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এ বিষয়টি এখন সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তুরুপের তাস:
এই বাস্তবতায় কোণঠাসা ইমরান তার হাতে আসা এমন একটি চিঠির কথা জানান, যাকে তিনি বলেছেন 'তুরুপের তাস'। সহজ কথায়, এই চিঠিকে তার রাজনৈতিক 'শেষ রক্ষাকবচ' বানিয়েছেন।
তিনি ওই বলেছেন, হুমকি সম্বলিত ওই চিঠি পাঠানো হয় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সংবেদনশীল তথ্য থাকায় সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করা যাবে না। তাছাড়া, যারা এর 'সত্যতা' নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, দেখানো হবে না তাদেরকেও। এর বাইরে পিটিআই সরকারের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের গণমাধ্যমের শীর্ষ সম্পাদক ও রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের চিঠিটি দেখাবেন তিনি।
ইমরানের চালের পর তার পদত্যাগকামী বিরোধী দলগুলোর সম্মিলিত জোট ও অন্যান্য মহল থেকে ওই চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানাতে ইমরানের প্রতি আহ্বান আসতে থাকে। চাপের মুখে অবশেষে সাংবাদিকদের সাথে বৈঠকে চিঠির কিছু অংশ জানিয়েছেন পিটিআই সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আসাদ ওমর। তবে মূল চিঠিটি দেখাননি।
সাংবাদিকদের আরও জানানো হয়েছে, এই চিঠি কোনো দেশ পাকিস্তানকে লেখেনি। পাকিস্তানী কোনো কূটনীতিকের পরিস্থিতি বিশ্লেষণও নয় সেটি। বরং বিশ্বের ক্ষমতাধর একটি দেশের সাথে পাকিস্তানী কূটনীতিকদের সংলাপের অনুলিখন।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আসাদ ওমর বলেছেন, ওই দেশটি আমাদের কূটনীতিককে যে বার্তা দিয়েছে, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে "ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট জয়যুক্ত হলে, পাকিস্তানের পূর্বের সকল দোষত্রুটি ক্ষমা করে দেওয়া হবে। অন্যদিকে, ব্যর্থ হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ।"
এসব কথা চিঠিতে রয়েছে বলে নিশ্চিত করেন ওমর, তবে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আইনের কারণে সরকারি এ গুরুত্বপূর্ণ নথির 'লাইন বাই লাইন' বিষয়বস্তু জানাতে অস্বীকার করেন।
চিঠিটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সাংবাদিকদের সন্দেহ দূর করার আহ্বান জানিয়ে ইমরান খান বলেছেন, এতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রচলিত কূটনীতিক শিষ্টাচারের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির বিবেচনায় হুমকি দানকারী দেশের নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
তিনি আরও জানিয়েছেন, মন্ত্রীসভার সকলকে চিঠিটি দেখানো হয়েছে এবং পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশনের ক্যামেরারায় ধারণকৃত অংশে চিঠিটি তুলে ধরা হবে।
পিটিআই সরকার আরও জানিয়েছে, পাকিস্তানী ওই কূটনীতিককে বলা হয়েছে ইউক্রেন ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানে সন্তুষ্ট নয় পশ্চিমা দেশগুলো। এসব দেশের সরকার প্রধানেরা মনে করেন, ইউক্রেন প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ইমরান খানের নিজস্ব নীতিরই ফসল।
এসব কথা যখন বলা হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানী ওই কূটনীতিক তার প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন। অন্য উপায়ে সমাধানের তাগিদ দেন। কিন্তু, ক্ষমতাধর অজ্ঞাত দেশটির ওই কর্মকর্তা তাতে কর্ণপাত করেননি।
আসাদ ওমর আরও জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরানের রাশিয়ার সফরই তার জন্য 'কাল' হয়েছে। এতে পশ্চিমা দেশগুলো প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়।
এর আগে ইমরান খান অবশ্য জানিয়েছিলেন যে, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ নেতৃত্ব এবং কয়েকজন সাবেক শীর্ষ কূটনীতিকের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই রাশিয়া সফরের সিদ্ধান্ত নেন। এতে তারা সকলেই সম্মতিও দিয়েছিলেন।
বিদেশি ওই কর্মকর্তার সাথে কথাবার্তার এক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন পাকিস্তানী কূটনীতিক। কিন্তু, তার জবাবে জানানো হয়, অনাস্থা ভোটের ফলাফলের ওপরই দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ভর করবে।
পাকিস্তানী সাংবাদিকদের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও হুমকিদাতা কূটনীতিক যে দেশের ছিলেন—সে দেশটির নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি ইমরান।
আসাদ ওমর জানিয়েছেন, মূল চিঠিটি নয় বরং এর কিছু অংশবিশেষই পার্লামেন্ট সদস্যদের জানানো হবে।
ইমরান জানিয়েছেন, এসব তথ্য জানার পর অনেকেই বুঝতে পারবেন তিনি এক বৈশ্বিক চক্রান্তের শিকার। এতে অনেক আইনপ্রণেতা তার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। আর তা না করলে, তারা নিজেদের ওই চক্রান্তের অংশীদার হিসেবেই প্রমাণ করবেন।
সবশেষে কী হবে?
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপ আজকের ঘটনা নয়। ইমরান খানের সরকারও তার শিকার হতে পারে—এমনটা দ্য ডনের আরেকটি সম্পাদকীয়তেও বলা হয়েছে।
ডনের সম্পাদকমণ্ডলী 'ক্যাপ্টেনের আখেরি বাজি' (ক্যাপ্টেনস লাস্ট গ্যামবিট) শীর্ষক ওই বিশ্লেষণে বলেছেন, সবদিক থেকে এখন চাপের মুখে ইমরান। সেনাবাহিনীর সাথে তার সখ্যতাও এখন হারিয়েছেন। সেনাবাহিনী যদি সত্যিই বিদেশি শক্তির ইন্ধনে বিরোধীদের মদদ দেয়, ইমরান হালে পানি পাবেন না। তাই আখেরি বাজি ধরেছেন ওই চিঠিতে। সত্যাসত্য যাই হোক, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনীতিতে তিনি নেমেছেন এক বিপজ্জনক খেলায়। এই অচলাবস্থার ফলাফল জানা যাবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে জাতীয় পরিষদে ভোটাভুটির পর।
পরিস্থিতি এমন যে, যদি কোনো দৈব কারণে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের মন বদলে ইমরানকে আবার সমর্থন দেয়, তাহলেই কেবল এ যাত্রায় তার প্রধানমন্ত্রিত্ব রক্ষা পাবে।
- সূত্র: দ্য ডন, দ্য নিউজ, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন