ব্যাঙ্গালুরু: ভারতের সিলিকন ভ্যালি যেভাবে ধর্মীয় রাজনীতির শিকার
সিলিকন ভ্যালির নাম শুনেই অনেকের চোখে ভেসে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের রৌদ্রজ্বল এক জনপদের কথা, যেখানে সাড়ি সাড়ি তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির ভিড়। সান ফ্রান্সিসকো উপসাগর তীরের এ অঞ্চলেই বিশ্বের প্রযুক্তি খাতের সেরা মেধাদের সমাবেশ। নিত্যনতুন চিন্তা, প্রগতিশীলতাই যেখানে জীবনযাত্রার অপরিহার্য অংশ।
দুনিয়ার আরেক প্রান্তে, আমাদের প্রতিবেশী ভারতেরও আছে নিজস্ব সিলিকন ভ্যালি, কর্ণাটক রাজ্যে– ব্যাঙ্গালুরু। কিন্তু, ভারতের তরুণ উদ্ভাবনী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী ও কোম্পানির এ শহর, বদলে যাচ্ছে ধর্মীয় বিভাজনে। দিন দিন তিক্ততা বাড়ছে একের সাথে অন্য সম্প্রদায়ের। এ যেন প্রগতির উল্টো রথযাত্রা।
সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প এতটাই বেশি যে, উত্তেজনা নিরসনে রাজনীতিবিদদের প্রতি আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়েছেন ভারতের সবচেতে ধনী নারী কিরন মজুমদার শ'। দেশটির জৈবপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ কোম্পানি- বায়োকন লিমিটেড ও বাইয়োলজিক্স লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারপার্সন হলেন এ বিলিয়নিয়ার।
কর্ণাটক রাজ্য সরকারে এখন শাসন বিজেপির, ধর্মীয় বিভাজনের আগুনে ঘি ঢালার কাজটিও তারাই করছে। এ অবস্থায় কিরন শ' রাজ্য সরকারের প্রতি "ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় বিভাজন" অবসানের আহ্বান জানান। কারণ দক্ষিণ ভারতের ৬ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার এ রাজ্যে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ আজ চরমে। আর তা নিয়েই উদ্বিগ্ন কিরন, কেননা ভারতের জমজমাট তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র- ব্যাঙ্গালুরুর বুকেই যে তার ব্যবসায়িক উদ্যোগ।
কর্ণাটকের মন্দির প্রাঙ্গণের মেলায় মুসলমান ব্যবসায়ীরা দোকান দেন, সাজিয়ে বসেন নানান পণ্যের পসরা। কিন্তু, এই সম্মিলন হিন্দুত্ববাদীদের চোখের কাঁটা। কর্ণাটকের কট্টরপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলো সম্প্রতি মুসলমান ব্যবসায়ীদের মেলায় দোকান দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলেছে। এতে ধর্মীয় বিভাজনের পারদ আরো চড়ে, এটিসহ আরো বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে মুখ ফুটে এমন আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়েছেন কিরন।
যেমন হালাল উপায়ে পশু জবাই করায়, উগ্র হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো রাজ্যের হিন্দুদের মুসলমান কসাইয়ের কাছ থেকে মাংস না কেনার আহ্বান জানাচ্ছে। তারা আরও দাবি তুলেছে, মসজিদে লাউডস্পিকার নিষিদ্ধের। হিন্দুদের প্রতি তারা মুসলমান আম বিক্রেতাদেরও বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে গত মাস কয়েক ধরেই। এই কর্ণাটক রাজ্যেরই একটি কলেজে হিজাব পরায় কয়েকজন মুসলমান ছাত্রীর কলেজে আসার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় রাজ্য সরকার। এরপর আদালতের এক রায়ে সেটি বাতিল করা হলেও; রায়ের প্রতিবাদে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি, শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হয়নি।
কর্ণাটকে প্রায় ১৩ শতাংশের মতো উল্লেখযোগ্য মুসলমান জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও, গেল বছর সেখানে গরু জবাই নিষিদ্ধ করে রাজ্য সরকার। হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ভগবত গীতা স্কুলের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে, প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে পাঠ্যবই থেকে ১৮ শতকের বিখ্যাত মুসলিম শাসক-মহিশুরের টিপু সুলতানের অধ্যায়টি বাদ দেওয়ার, কারণে এতে টিপুকে নাকি "অনেক বেশি মহিমাণ্ডিত" দেখানো হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এসব কারণে ধর্ম অনুযায়ী বিভাজিত হচ্ছে জনতা। সমালোচকরা এসব পদক্ষেপকে মনে করছেন, কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারের মুসলমানদের বঞ্চনা ও নিপীড়ন চেষ্টারই অংশ। তাদের আশঙ্কা, তাতে পরিস্থিতির এমন অবনতি হবে- যা ভারতের তুলনামূলক সমৃদ্ধ এই রাজ্যের ভাবমূর্তি পুরো বিশ্বের কাছে কালিমালিপ্ত করবে।
কিরন শ' টুইটারে তার বার্তা দেন। টুইটে তিনি ট্যাগ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাসাভারাজ বুমমাইকে। যেখানে কিরন লিখেছেন, "কর্ণাটক সব সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের শক্তিতে চালিত হয়েছে। তথ্য ও জৈব প্রযুক্তির এ শহরটিও (ব্যাঙ্গালুরু) সাম্প্রদায়িক হয়ে গেলে, বিশ্বে নেতৃত্বমূলক অবস্থানও হারাবে।"
তার শঙ্কা নিঃসন্দেহে বোধগম্য, কারণ কর্ণাটকের অর্থনৈতিক সফলতা আসে ব্যাঙ্গালুরু থেকেই। প্রায় এক কোটি অধিবাসীর ব্যতিবস্ত, প্রাণবন্ত এ নগর রাজ্য সরকারের রাজস্বের ৬০ শতাংশের বেশি যোগান দেয়। সেখানে রয়েছে ১৩ হাজারের বেশি প্রযুক্তি-ভিত্তিক স্টার্ট-আপ। শতাধিক কোটি ডলার বাজার মূল্যায়িত ১০০টি ভারতীয় কোম্পানির ৪০ শতাংশ, যাদের বলা হয় ইউনিকর্ন। ব্যাঙ্গালুরুর কল্যাণেই হয় সমগ্র ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানির ৪১ শতাংশ।
অথচ এই ব্যাঙ্গালুরু এবং সার্বিকভাবে কর্ণাটক রাজ্যই- ধর্মীয়ভাবে বিভাজিত এক অঞ্চল–যেখানে অতীতেও হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংঘাত। শহরের উপকন্ঠে অফিস খুলে সমাজের 'অভ্যন্তরীণ হানাহানি' এড়াতে এতদিন ধরে সফল হয়েছে প্রযুক্তি উদ্যোগগুলি। সেখানে তারা নিজস্ব অবকাঠামো গড়ে তুলে, পুরো বিশ্বে ব্যাঙ্গালুরুর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। এমনটাই জানান সেখানকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক নরেন্দ্র পাণি।
তবে এই কর্ণাটকই আবার দক্ষিণ ভারতে বিজেপির প্রভাব বিস্তারের নয়া কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে কেবল এখানেই তারা ক্ষমতায় রয়েছে। কর্ণাটক বহু সংস্কৃতি, সম্প্রদায়, বর্ণ (হিন্দু ধর্মের) ও ভাষাভাষী গোষ্ঠীর আবাস হলেও, গত চারটি সাধারণ নির্বাচনে টানা জয়ী হয়ে এখানে ক্ষমতায় রয়েছে বিজেপি।
এ রাজ্যের উপকূলীয় অঞ্চল ও গ্রামে যেখানে অধিকাংশ মুসলমানের বসবাস, সেখানে অনেক বছর ধরে বিজেপি তাদের কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি করে আসছে। বিজেপির আদর্শিক সূতিকাগার- আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ)- এর এসব এলাকার স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে রয়েছে, গভীর সমর্থনের শিকড়। অতীতে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো এসব এলাকায় পানশালায় আসা নারী ও পুরুষের ওপর হামলা চালিয়ে এবং 'লাভ জিহাদ' এর ধুয়ো তুলে 'নৈতিক পুলিশিং'- আরোপের চেষ্টা করেছে। 'লাভ জিহাদ' বলতে তারা বোঝায়, মুসলমান পুরুষদের হিন্দু নারী বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করার কথিত 'উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডকে'।
কর্ণাটকে হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা-ভিত্তিক আনুগত্যই ছিল দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী রাজনীতির মূল নিয়ন্তা। ২০০৮ সালে এ রাজ্যে প্রথম বি. এস. ইয়েদুরাপ্পার নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসে, তিনি লিঙ্গায়তদের সাথে এক সফল জোট গঠনের মাধ্যমে এ বিজয় নিশ্চিত করেন। এই লিঙ্গায়তরা রাজ্যের সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত বর্ণ হলেও- তারা মোট ভোটারের ছয় ভাগের একভাগ।
কিন্তু লিঙ্গায়তদের একটি দল নিজেদেরকে হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা বিশ্বাস হিসেবে স্বীকৃতি চায়। তাদের পক্ষ থেকে সুবিধাবঞ্চিত জাতিদের জন্য নানান রকম সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি রয়েছে। কর্ণাটক রাজ্য থেকে একমাত্র ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এইচডি দেবগৌড়া। তার জীবনীকার সুগত শ্রীনিবাসরাজু বলেছেন, "চাপের মুখে, বিজেপি এখন একটি ভিন্ন রাজনীতি তৈরি করার চেষ্টা করছে। দলটি হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে ভোটার সমর্থন তৈরির চেষ্টা করছে"।
গেল বছর ইয়েদুরাপ্পার থেকে দায়িত্বগ্রহণ করেন ৬১ বছরের তুলনামূলক স্বল্প-পরিচিতির শ্রী বুমমাই। সমালোচকদের মতে, এপর্যন্ত তার সরকারের পারফর্ম্যান্স হতাশাজনক। রয়েছে মহামারিকালে ব্যাপক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। সরকারের অভ্যন্তরীণ একটি পর্যালোচনাতেই দেখা গেছে, সরকারের সব বিভাগই নিম্ন-কর্মতৎপরতার শিকার। এ তথ্য আবার ফাঁস করে দেয়, দ্য ফাইল নামক স্থানীয় একটি বিশিষ্ট গণমাধ্যম, যাদের রয়েছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের সুনাম।
উন্নয়নের গতি রুদ্ধ করছে ব্যাপক দুর্নীতি। ব্যবসায়ীরা তাতে অতিষ্ঠ। গেল বছর এক বিস্ময়কর কাজই করে বসেন রাজ্যের বেসরকারি ঠিকাদাররা। তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে লেখা এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, রাজ্যের মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদেরকে প্রকল্পপ্রতি মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। আরো রয়েছে, উন্নয়নের বরাদ্দ অর্থ ব্যয় না হওয়া, সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা বাকি থাকা এবং সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বরাদ্দ বৃত্তির টাকা দিতে দেরির ভূরি ভূরি সংবাদ।
এমন পরিস্থিতিতে আগামী বছরই হবে রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচন। ব্যাঙ্গালুরু-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক চেঞ্জের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক চন্দন গৌড় বলেন, "সব দেখে মনে হয়, সরকারের হাতে এখন কেবল হিন্দু জাতীয়তাবাদের চালই অবশিষ্ট আছে।"
কিরন শ'র মতো প্রভাবশালী উদ্যোক্তার আহ্বানের পর মুখ্যমন্ত্রী বুমমাই জনতার প্রতি 'শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় সহযোগিতা' নিশ্চিতের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "কর্ণাটক- শান্তি ও উন্নতির জন্য সুপরিচিত, সবাইকে আরো সংযত হতে হবে।"
তার দলের কিছু নেতাও ধর্মীয় রাজনীতির হিংসাত্মক কৌশল নিয়ে পুরোপুরি একমত নন।
তাদেরই একজন আইনপ্রনেতা এএইচ বিশ্বনাথ মন্দিরের উৎসবের মেলায় মুসলমান ব্যবসায়ীদের বাধাদান প্রসঙ্গে বিবিসি হিন্দিকে বলেন, "এক্ষেত্রে অস্পৃশ্যতা ছাড়া আর কোনো বিবেচনা কাজ করেনি… নিঃসন্দেহে এটি একটি অমানবিক প্রথা।"
অনীল বেনাকে নামের অপর বিজেপি আইনপ্রণেতার মন্তব্য, "আমরা মন্দিরের উৎসবে মুসলমানদের ব্যবসায় বাধা দেব না।"
সরকারি দলের উগ্র রাজনীতির নিন্দা ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে অনেক হিন্দু আবার লাইন দিয়ে মুসলমান কসাইয়ের দোকান থেকে মাংস কিনছেন।
এসব প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও আশা জাগায়। তবে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প দূর করতে এখনও অনেক কিছুই করা বাকি।
সুগত শ্রীনিবাসরাজু বলেন, "গত দুই দশক ধরে কর্ণাটকের রাজনীতিকে ধর্মীয় রূপদানের ধারাবাহিক চেষ্টা চলছে। অনেক বছর ধরেই এসব কিছু দেখেবুঝেও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও ব্যবসায়ী নেতারা। নিজ মতামতের মিথ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা না করে, তাদের এখন প্রকাশ্যে সাহসী প্রতিবাদ জানাতে হবে।"
- সূত্র: বিবিসি