রাশিয়ার সারম্যাট ও চীনের ওয়াইজে-২১ আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রকে কেন পশ্চিমা দুনিয়া ভয় পাচ্ছে
দিনকয়েক আগেই অত্যন্ত দূরপাল্লার একটি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে মস্কো। গত বুধবার পশ্চিম রাশিয়ার প্লেসেটস্ক অঞ্চলের গোপন সাইলো (ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের ভূগর্ভস্থ স্থাপনা) থেকে সর্বাধুনিক এই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়।
সারমাট নামের বিশ্বের সবচেয়ে ভারী ওজনের মিসাইলটি ছিল আইসিবিএম শ্রেণির। উৎক্ষেপণের পর এটি ৬ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে বিশাল দেশ রাশিয়ার সুদূর পূর্ব প্রান্তের কামচাটকা উপদ্বীপে নির্ধারিত কিছু লক্ষ্যে আঘাত হানে।
দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়া এই মিসাইলটি তৈরির গবেষণা করেছে। লক্ষ্য ছিল, নতুন অস্ত্র সোভিয়েত যুগের এস-১৮ শ্রেণির আইসিবিএম'গুলোকে প্রতিস্থাপন করবে। অর্থাৎ, সারমাট সার্ভিসে যুক্ত হবে, আর তার ভিত্তিতে বাতিল হবে পুরনো মিসাইল।
সারমাটের সফল পরীক্ষার মাধ্যমে রাশিয়া সে কাজে সফল হয়েছে বলা যায়। এই ক্ষেপণাস্ত্র এতটাই বিধ্বংসী ক্ষমতার যে ন্যাটো এর সাংকেতিক নাম দিয়েছে 'সাতান-২' বা শয়তান-২।
নতুন এই আইসিবিএম পুরো পৃথিবী ঘুরে গিয়ে তার নির্ধারিত লক্ষ্যে একাধিক পরমাণু বোমা বা ওয়ারহেড নিক্ষেপে করতে পারবে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আইসিবিএম তৈরির প্রতিযোগিতায় নেমেছিল আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ও রাশিয়া। এ অস্ত্র ব্যবহার হলে ঘটতো মহাপ্রলয়। তাতে পুরো পৃথিবী ফিরতো প্রস্তুর যুগে। তাই নিজস্ব আইসিবিএম ভাণ্ডার প্রতিপক্ষকে তার অস্ত্র ব্যবহার থেকে নিরস্ত্র রাখবে- এমন উদ্দেশ্য ছিল দুই পরাশক্তির। বিশেষজ্ঞরা যার নাম দেন- মিউচ্যুয়ালি অ্যাসিউরড ডিসট্রাকশন বা ম্যাড ডকট্রিন।
আইসিবিএম- প্রযুক্তির উন্নতির কারণে বিজ্ঞানী মহল শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। বিশ্বের প্রায় সকল পরাশক্তির বিজ্ঞানীরা তাদের সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হন- এভাবে পরমাণু অস্ত্র দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধালে পৃথিবী থেকে মানব জাতির অস্তিত্ব লোপ পাবে।
একারণেই যুগ যুগ ধরে সাইলোতে অলস পরে রয়েছে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাষ্ট্রের শত শত আইসিবিএম। মানবাজাতিকেও সেই সুবুদ্ধির কল্যাণে লোপ পেতে হয়নি। তবে কয়েক দশকের পুরনো এসব ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকায়ন এখন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নাহলে শত্রুর বিরুদ্ধে হুমকি বা ম্যাড ডকট্রিন অকেজো হয়ে পড়বে।
আমেরিকা ও রাশিয়া উভয় দেশই এজন্য তাদের আইসিবিএম ভাণ্ডার আধুনিকায়ন অব্যাহত রেখেছে। শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে নিত্যনতুন সক্ষমতা যোগ হচ্ছে নয়া প্রজন্মের আইসিবিএমে।
সেদিক থেকে সারমাট মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে এক আতঙ্কের নাম। এটির পাল্লা বা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা প্রায় ৩৫ হাজার কিলোমিটার। ফলে সরাসরি নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে উড়ে না গিয়ে, এটি পৃথিবীর অন্য যেকোনো অঞ্চল হয়ে ঘুরে সেখানে আঘাত হানতে পারবে। এই কৌশলে অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে আঘাত হেনে, ফাঁকি দিতে পারবে শত্রুর শনাক্তকরণ রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থাকে।
সারমাটের সর্বাধুনিক সংস্করণ ১০ টন পেলোড বহন করতে পারে, যাতে রাখা যায় রাশিয়ার ১৫টি অত্যন্ত শক্তিশালী পরমাণু ওয়ারহেড। ওয়ারহেডগুলো ক্ষেপণাস্ত্র থেকে বিচ্যুত হওয়ার পর লক্ষ্যবস্তুর দিকে গতিপথ বদলে আঘাত হানতে পারে।
রাশিয়া এই বহন ক্ষমতাকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে। সাধারণ ওয়ারহেডের বদলে সারমাটে দেশটির সর্বাধুনিক হাইপারসনিক মিসাইল আভনগার্ড যুক্ত করার কথা জানা গেছে। এই মিসাইল পরমাণু অস্ত্রের পাল্লা আরও অনেক দূর বাড়িয়ে দেবে, আঘাতও হানবে আরও দ্রুত গতিতে। ফলে শত্রু কোনো কার্যকর প্রতিরোধ করতে পারবে না।
সেক্ষেত্রে একমাত্র উপায় সারমাট উৎক্ষেপণের সময় এটির রকেট ইঞ্জিন নির্গত তাপ শনাক্তের মাধ্যমে হুমকি শনাক্তকরণ। কিন্তু, সারমাট বিশালাকায় হলেও প্রাথমিক উৎক্ষেপণে সময় খুবই কম নেয়। এত কম সময়ে আমেরিকার গোয়েন্দা উপগ্রহের সারমাট নিক্ষেপ শনাক্ত করার সুযোগ খুব কমই পাবে।
এভাবে প্রতিপক্ষকে চমকে দিয়ে অতর্কিতে প্রথম আঘাত হানার সুযোগ মস্কোর হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সারমাট। একাধিক সারমাট দিয়ে হামলা চালিয়ে চোখের পলকে আমেরিকার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঞ্চল সম্পূর্ণ ধবংসস্তূপে পরিণত করে দিবে এই আইসিবিএম। সীমিত করবে পাল্টা আঘাত হানার শক্তি।
সরল ভাবে বলা যায়, সারমাট বিশালাকায়, অত্যাধুনিক এক যুদ্ধাস্ত্র, যার আক্রমণ ঠেকানো এক কথায় প্রায় অসম্ভব। রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্রসজ্জায় নতুন প্রজন্মের যেসব মিসাইল যুক্ত হয়েছে- তার কাতারেই রয়েছে সারমাট।
শব্দগতির প্রায় পাঁচগুণ দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্রকে বলা হয় হাইপারসনিক মিসাইল। রাশিয়াই প্রথম হাইপারসনিক মিসাইল তাদের অস্ত্রভান্ডারে যুক্ত করে এবং প্রথম দেশ হিসেবে এটি শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহারও করেছে।
তবে রাশিয়া এদিক থেকে একমাত্র দেশ নয়। রাশিয়ার পর হাইপারসনিক মিসাইল প্রস্তুত ও সামরিক সার্ভিসে যুক্তকারী দ্বিতীয় দেশ হচ্ছে-চীন। একুশ শতকের এই মারণাস্ত্রটির আরও উন্নয়নে বিপুল বিনিয়োগ করে চলেছে বেইজিং।
চীনের ওয়াইজে- ২১ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার নেপথ্যে
রাশিয়ার সারমাট আইসিবিএম পরীক্ষার মাত্র একদিন আগে চীন তাদের সম্পূর্ণ নতুন হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষা চালায়। এটি নিক্ষেপ করে গণচীনের নৌবাহিনীর একটি টাইপ-জিরো ফাইভ ফাইভ হেভি ক্রুজার যুদ্ধজাহাজ। ওয়াইজে-২১ নামক এ ক্ষেপণাস্ত্র উড়তে পারে অবিশ্বাস্য গতিতে এবং আন্দাজ করা যায় না এমন গতিপথে। মার্কিন নৌবাহিনীর শক্তির উৎস- বিমানবাহী রণতরী ধবংস করাই এ মিসাইলের প্রাথমিক লক্ষ্য। এজন্য এটিকে 'ক্যারিয়ার কিলার'-ও বলছেন অনেক সমর বিশেষজ্ঞ।
পৃথিবীর মহাসমুদ্রগুলোয় আমেরিকার শক্তি ও সামর্থ্যের প্রতীক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরী। কিন্তু, একটি ক্যারিয়ারকে সুরক্ষা দেয় আরও অনেক যুদ্ধজাহাজ। মিলিতভাবে তারা এক একটি ক্যারিয়ার গ্রুপ গঠন করে। এসব নৌবহরের শক্তি সম্পর্কে চীন ভালোভাবেই উপলদ্ধি করেছে। আর তাই আমেরিকার সাথে যেকোনো যুদ্ধ-সংঘাত বাঁধলে প্রথমেই এসব ক্যারিয়ার গ্রুপ ধবংস করে দিতে চায় বেইজিং।
ক্যারিয়ার গ্রুপের নিজস্ব আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও প্রচণ্ড শক্তিশালী। এসব ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে আমেরিকার গর্বের রণপোতগুলি ডুবিয়ে দেওয়ার মতো অস্ত্র আবিষ্কারে প্রাণাতিপাত চেষ্টা করছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। ওয়াইজে-২১ এর সফল পরীক্ষা সে লক্ষ্যপূরণে চীনকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেল।
প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার পাল্লার ওয়াইজে-২১ একটি বড় ওয়ারহেড বহন করতে পারে। এটির গতি এত বেশি যে ওপর থেকে আঘাত হেনে বিমানবাহী রণতরীর মজবুত ফ্লাইট ডেক ভেদ করতে পারবে অনায়সে। এমন মারাত্মক আঘাতে তাৎক্ষনিকভাবে ধবংস হয়ে যাবে অন্তত এক লাখ টন ওজনের এসব মহাকায় রণতরী।
হাইপারসনিক মিসাইল সাধারণত কোনো বোমারু বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু চীন করেছে সমুদ্রগামী যুদ্ধজাহাজ থেকে। যার অর্থ চীন তার নিজস্ব নৌবহর দিয়ে আমেরিকার নৌশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি অর্জন করলো।
আমেরিকার রণতরীগুলো এখন রয়েছে তাদের সর্বাধুনিক পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এফ-৩৫সি। কিন্তু, এই বিমান যতটা দূর যেতে পারে, তার চেয়েও বেশি পাল্লার হলো চীনের নতুনতম হাইপারসনিক অস্ত্রটি। ফলে মার্কিন বিমানের আওতার বাইরে থেকেই হামলা চালানোর সামর্থ্যের জানান দিল বেইজিং। তাই এখন থেকে অতর্কিত হামলার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়লো মার্কিনীদের।
রাশিয়া ও চীন আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে
রাশিয়া ও চীন—দুই দেশের যৌথ সীমান্ত প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। শত্রুও এক ও অভিন্ন—পশ্চিমা দুনিয়া—বিশেষত আমেরিকা।
সাম্প্রতিক সময়ে উভয় রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা খাত ও সামরিক পরিকল্পনায় সহযোগিতা বাড়িয়ে চলেছে। মার্কিন গোয়েন্দারা মনে করেন, ৬০ বছর আগের তুলনায় মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক অনেক বেশি উষ্ণ।
দুই দেশের যৌথ নৌমহড়ার আকার প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। চীনের অনেক যুদ্ধবিমান রাশিয়ান ডিজাইনে তৈরি। বিশাল সীমান্ত থাকায় দুই দেশের মধ্যে স্থল সামরিক মহড়া পরিচালনাও অপেক্ষাকৃত সহজ। এবং তাতে করে মহড়ার পরিকল্পনায় অনেক জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও প্রকৃত যুদ্ধ-পরিস্থিতি ফুটিয়ে তোলা যাচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে পশ্চিমা অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব। রাশিয়া সহজ জয়লাভে ব্যর্থ হওয়ায় মস্কো ও চীন বুঝতে পারছে- পশ্চিমাদের হারাতে হলে তাদের ভবিষ্যতের যুদ্ধের ময়দানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে হবে। এই উপলদ্ধি তাদের মধ্যকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও গভীর করবে।
প্রতীকী বার্তা:
চীন ও রাশিয়া তাদের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা গোপনে করেনি। করেছে প্রকাশ্যে এবং ব্যাপক প্রচার চালিয়ে। এতে বোঝা যায়, তারা বিশ্বকে নিজেদের মারাত্মক অস্ত্রগুলো সম্পর্কে জানাতেই চেয়েছে। তারা চেয়েছে পশ্চিমা দুনিয়া তাদের শক্তি খাটো করে না দেখুক। জানুক, আক্রমণ চালাতে তারা কোনো অংশেই কম নয়।
রাশিয়া এই পরীক্ষার মাধ্যমে ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীর ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চেয়েছেন। একইসঙ্গে, ন্যাটোকে জানিয়ে দিলেন, রাশিয়া এখনও কাগুজে বাঘ হয়ে যায়নি, বরং দরকার হলে তার পারমাণবিক দাঁতে ছিঁড়তে পারবে ইউক্রেনের সমর্থক ইইউ ও আমেরিকাকে।
একইভাবে চীনও বুঝিয়ে দিল, দেশটির সাথে ভবিষ্যতে সংঘাতে জড়ালে চরম মূল্য দিতে হবে। বেইজিং আরও জানালো, নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কারো নাক গলানো বন্ধ করতে তাদের প্রস্তুতির কোনো কমতি নেই।
ইউক্রেনে প্রতিবেশী রাশিয়ার যুদ্ধকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীন এ যুদ্ধে রাশিয়ার ব্যর্থতাগুলো থেকেও শিক্ষা নিচ্ছে। যুদ্ধের প্রথমদিকে ইউক্রেনের বিমান বাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধবংসে রাশিয়ার ব্যর্থতা চীনের সমরবিদদের ভাবাচ্ছে।
নবগঠিত রুশ বাহিনীর সম্মান ইউক্রেনে প্রায় মাটিতে মিশেছেই বলা যায়। এতে করে আগামীদিনে দুই দেশের মধ্যেকার প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় চীনের আধিপত্য বাড়বে অনেকটাই।
এক কথায় বলা যায়, বুধবারের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা রাশিয়া চালিয়েছে মরিয়া হয়ে, অন্যদিকে চীনের পরীক্ষা ছিল এক কড়া হুঁশিয়ারি।
- সূত্র: আল জাজিরা