ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য দেওয়ার বড়াই করে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে আমেরিকা
চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন রুশ জেনারেল। আর তাদেরকে হত্যায় গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করেছে আমেরিকা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)। সম্প্রতি পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারাই এ তথ্য গর্বভরে জানিয়েছেন, যা কিনা রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধকে উস্কে দিচ্ছে।
তবে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বর্তমান কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা যেন এ ধরনের সাফল্যের কথা উচ্চকণ্ঠে প্রচার করে না বেড়ান। ইউক্রেনের সামরিক সাফল্যের পেছনে নিজেদের ভূমিকার ব্যাপারে মার্কিন গোয়েন্দাদের মুখে কুলুপ আঁটার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এনবিসি নিউজের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এসব তথ্য প্রদানের খবর প্রকাশ্যে এলে লক্ষ্য থেকে 'মনোযোগ সরে যায়' বলে গোয়েন্দাদের চুপ থাকার আদেশ দিয়েছেন তিনি।
এ সপ্তাহে দুটি গল্প প্রকাশ্যে আসে আমেরিকান সংবাদমাধ্যমে। অজ্ঞাতনামা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ জেনারেলদের হত্যা করতে এবং কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ ক্রুজার মস্কভা ডুবিয়ে দিতে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে বুধবার প্রকাশিত প্রথম প্রতিবেদনের তথ্য অস্বীকার করে হোয়াইট হাউস। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের গোপন খবরাখবর ইউক্রেনকে সরবরাহের বাইডেন প্রশাসনের গোপন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রুশ জেনারেলদের টার্গেট করা-বিষয়ক গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা হয়। অবশ্য মার্কিনীদের গোয়েন্দা তথ্যের সুবাদে ঠিক কতজন রুশ জেনারেল নিহত হয়েছেন, তা সেখানে জানানো হয়নি।
এর পরদিন (বৃহস্পতিবার) এনবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে জানায় যে, মার্কিন গোয়েন্দারা গত মাসে মস্কভাকে লক্ষ্য করে অ্যান্টিশিপ মিসাইল ছুড়তে ইউক্রেনকে সাহায্য করেছেন। জাহাজটির অবস্থান সম্পর্কে ইউক্রেনকে তথ্যও দেয় আমেরিকা।
গুপ্তচরবৃত্তির সর্বজনস্বীকৃত নিয়ম হচ্ছে, এ কাজ করা হয় গোপনে, সবার অগোচরে। কিন্তু চলমান যুদ্ধের বেলায় সম্পূর্ণ উল্টোটা করছে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ইউক্রেনে হামলার বিষয়ে রাশিয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে যা যা জানতে পারছে, তা-ই জনসমক্ষে নিয়ে আসছে তারা। এছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিদিনের প্রতিবেদনও জানিয়ে দিচ্ছে প্রকাশ্যে।
তবে সর্বশেষ যেসব তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, তা একেবারেই আলাদা। কেননা এবার যেসব তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, তার সবই মার্কিন গুপ্তচর সংস্থাগুলোর নিজেদের কাজ-সংক্রান্ত, যুদ্ধের পরিস্থিতি-সংক্রান্ত মন্তব্য নয়।
কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এসব বাগাড়ম্বর পছন্দ করছেন না দেশটির সাবেক কর্মকর্তারা। তাদের মতে, নিজেদের গোয়েন্দা কার্যকলাপের 'কীর্তি' এভাবে প্রকাশ্যে বলে বেড়ানোটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বেশ কয়েকজন সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা ও সরকারি কর্মকর্তা বাইডেন প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন গোয়েন্দা কার্যকলাপ যেন জনসমক্ষে না আসে।
৫ মে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন- আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটো যে কিয়েভকে নিয়মিত গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে আসছে রুশ কর্তৃপক্ষ তা খুব ভালো করেই জানে।
সাবেক সিনিয়র সিআইএ কর্মকর্তা পল পিলার বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, কাজটি অবিবেচকের মতো হয়েছে। মস্কভা ডুবি—এবং এরপর জেনারেলদের হত্যায় মার্কিন গোয়েন্দাদের ভূমিকার কথা এরকম আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি।
'বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমেরিকার ভূমিকার কথা এভাবে প্রকাশ্যে নিশ্চিত করা হলে পুতিন উস্কানি পেয়ে যেতে পারেন। ফলে অভাবনীয় কিছু (পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার) করে বসতে পারেন তিনি, যা অন্য পরিস্থিতিতে করার প্রয়োজন বোধ করতেন না।'
সিআইতে ২৮ বছর কাজ করা জন সাইফার অবশ্য মনে করছেন ইউক্রেনকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহের ব্যাপারটা প্রকাশ্যে আনা হয়েছে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে। তবে একে তিনি ইউক্রেনের জন্য অপমানজনক বলেও মনে করেন।
তিনি বলেন, 'আমার মনে হয় এটি ইউক্রেনীয়দের জন্য অসম্মানজনক।' এতে যারা যুদ্ধের মাঠে দিন-রাত লড়াই করছে, তাদের কৃতিত্ব খাটো করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাইফার।
তবে এসব তথ্য প্রকাশ্যে আসায় রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা তেমনভাবে বেড়েছে বলে মনে করেন না তিনি।
সাইফার বলেন, 'খেলাটা কীভাবে হয়, পুতিন তা জানেন। পরিস্থিতি উল্টে গেলে তিনি গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে আমেরিকানদের হত্যা করার চেষ্টা করবেন, যেমনটা তিনি আফগানিস্তান ও অন্যান্য জায়গায় করেছেন। রাশিয়া বহু বছর ধরেই আমাদের উপর সাইবার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।
'কাজেই আমার মনে হয় না যে আমেরিকার এসব গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের ব্যাপার প্রকাশ্যে আসায় তারা খুব বেশি বিচলিত হবে।'
ইউরোপীয় কর্মকর্তারা অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আমেরিকার পথে হাঁটবে না।
একজন কর্মকর্তা বলেছেন, 'এটা বোকামি। তথ্যগুলো খুব সুচিন্তিতভাবে ফাঁস করা হয়েছে বলে মনে হয় না আমার।'
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান