৯০% নারী কর্মশক্তির বাইরে, ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতির ঝুঁকিতে ভারতের অর্থনীতি
কর্মস্থলে নারীর অংশগ্রহণ তাদের ক্ষমতায়নসহ পুরো সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো উন্নয়নে একান্ত জরুরি। ভারত বিশ্বের উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশ। রয়েছে চীনকেও ছাড়িয়ে অর্থনীতির আরও শিখরে পৌঁছানোর উচ্চাভিলাষ। তবুও কর্মীবাহিনীতে নারীর সংখ্যা কমেছে দেশটিতে। এতে করে ট্রিলিয়ন বা লাখ কোটি ডলারের সম্ভাবনা হারিয়ে যেতে বসেছে।
এমনই এক নারীর কাহিনি এই ঘটনার নেপথ্যে অসংখ্য জীবনের উত্থাল-পাতাল হয়ে যাওয়াকে বর্ণনা করে। সঞ্চরী ভুনিয়া নামের এই তরুণীকে বিয়ে করে ঘর-সংসারের চাপ দেন তার বাবা-মা। কিন্তু, সঞ্চরী শুধু গৃহবধু হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর্থ-সামাজিক স্বাধীনতা। তাই একদিন কাউকে না জানিয়ে ট্রেনে চেপে পূর্ব ভারতে অবস্থিত তার গ্রামটি ছেড়ে শত শত মাইল দূরে দক্ষিণ ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে আসেন। ২০১৯ সালে এখানেই একটি পোশাক কারখানায় মেলে কাজ। বেতন ছিল মাসে প্রায় ৯ হাজার রুপির কিছু বেশি।
উপার্জন আহামরি না হলেও তাতেই খুশি ছিলেন সঞ্চরী। তিনি যেন প্রথম স্বাধীন জীবনের স্বাদ পাচ্ছিলেন। মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদকদের তিনি বলেন, "বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। এখানে আসার সেটাই ছিল একমাত্র রাস্তা।"
সঞ্চরী অবশ্য জানতেন না আর সবকিছুর মতো তার জীবনকেও উল্টেপাল্টে দিতে চলেছে কোভিড-১৯ নামের মহাব্যাধী। মহামারি যখন ভারতে হানা দেয় তখন আর্থিক এই স্বনির্ভরতা হারান সঞ্চরী।
২০২০ সালের ওই সময়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তার রোধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার, দেশজুড়ে লকডাউন জারি করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে সাথে সঞ্চারী যেখানে কাজ করতেন সেই কারখানাও বন্ধ রাখা হয়। সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে বেকার হয়ে পড়েন ১০ কোটির বেশি ভারতীয়। জীবিকার উৎস হারিয়ে নিরুপায় সঞ্চরী গ্রামে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এরপর মহামারি পরিস্থিতির উন্নতি হলেও আজো কোনো স্থায়ী চাকরি পাচ্ছেন না তিনি।
গল্পটি পুরো পৃথিবীতে কমবেশি বহু নারীর। তাই মহামারির প্রকোপ থেকে যখন বিশ্ব বেড়িয়ে আসতে শুরু করে তখনই অর্থনীতিবিদেরা উদ্বেগজনক একটি তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করে সতর্ক করেন। তথ্যটি হলো—নারীর চাকরি হারানো নারীদের পুনঃকর্মস্থান নিশ্চিত না করতে পারলে বৈশ্বিক অর্থনীতি থেকে লাখ লাখ কোটি ডলারের সমান প্রবৃদ্ধি হারিয়ে যাবে। ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় এই ক্ষতির ভাগও সেখানে বেশি।
তাই অর্থনীতিবিদদের দেওয়া আভাস ছিল ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য শঙ্কাজনক। আর তা বাস্তবেও রূপ নিয়েছে। সেখানে কর্মস্থলে নারীর যোগদান অত্যন্ত কমে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইয়েমেনের কাতারে নেমে এসেছে।
বিশ্বব্যাংকের সংকলন করা তথ্যউপাত্ত অনুসারে, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ভারতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ২৬ শতাংশ থেকে কমে ১৯ শতাংশ হয়েছে। করোনা সংক্রমণ যখন আরও বাড়ছিল তখন এই খারাপ পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে উঠতে থাকে। মুম্বাই-ভিত্তিক অর্থনীতিবিদদের হিসাব অনুসারে, ২০২২ সালে নারী কর্মসংস্থান মাত্র ৯ শতাংশে পতন হয়েছে।
মহামারির আগেই গতি হারাতে শুরু করেছিল ভারতের অর্থনীতি, তার ওপর এটি ছিল এক চরম দুঃসংবাদ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্যও যা উদ্বেগের।
নরেন্দ্র মোদি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতে 'অমৃত কাল' বা বিকাশের সোনালী যুগের সূচনা করার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার প্রশাসন কর্মজীবী নারীর জন্য জীবিকা অর্জনের সম্ভাবনা সেভাবে বৃদ্ধি করতে পারেনি।
গ্রামীণ জনপথে এই ব্যর্থতা আরও বেশি চোখে পড়ে। অথচ মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা ১৩০ কোটি ভারতীয়'র বসবাস কিন্তু গ্রামেই। সেখানে রক্ষণশীল চিন্তাচেতনার আধিপত্য, সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজালে সেখানে নারী কর্মসংস্থান আগে থেকেই কম ছিল। ভারতীয় অর্থনীতি কয়েক দশকে ব্যাপক সম্প্রসারিত হলেও শহরাঞ্চলে কাজে যেতে এখনও নারীদের বাধার মুখে পড়তে হয়। সেখানে গিয়ে কাজ পাওয়াও তাদের জন্য কষ্টকর।
অথচ নারী ও পুরুষের মাঝে কর্মসংস্থানের অসমতা কমিয়ে আনা গেলে – যা সুবিশাল ৫৮ শতাংশ– ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে। মার্কিন ডলারে যার পরিমাণ প্রায় ৬ লাখ কোটি বলে ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে।
এই বৈষম্য কমাতে চেষ্টা না করলে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী উৎপাদক হয়ে ওঠার লক্ষ্যচ্যুত হবে ভারত। কারণ দেশটিতে মোট জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ নারী হলেও, জিডিপিতে তাদের অবদান মাত্র ১৭ শতাংশ। সে তুলনায় চীনে এ অবদান ৪০ শতাংশ।
ভারতে নারীর এ পিছিয়ে থাকা বৈশ্বিক প্রবণতার একটি চরম দৃশ্যপট। পুরো বিশ্বে মহামারিকালে পুরুষের চেয়ে চাকরি বেশি হারিয়েছেন নারীরা। সেখান থেকে পুনরুদ্ধার হচ্ছে খুব ধীর গতিতে।
ব্লমবার্গ ইকোনমিক্সের বিশ্লেষণ মতে, লিঙ্গ বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি নারী কর্মসংস্থান বাড়াতে ভূমিকা রাখে এমন নীতি সহায়তা যেমন–শিক্ষার সুযোগ উন্নতকরণ, শিশু সেবা এবং উপযোগী কর্মপরিবেশ তৈরি করা গেলে– ২০৫০ সাল নাগাদ নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০ লাখ কোটি ডলার যোগ হবে।
প্রথমে বলা সঞ্চরী ভুনিয়ার কাহিনিতে ফিরে আসা যাক। সেই ২৩ বছরের তরুণী মহামারির চরম পরিণতির শিকার হন। কাজ হারানোর পর তার কাছে বেঙ্গালুরু শহরে ছিল না খাবার কেনার টাকা। এরপর উড়িষ্যার প্রত্যন্ত পত্রপলী গ্রামে ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি আর শহরে ফেরার সুযোগ পাবেন না বলেই জানান। বর্তমানে তার কোনো স্থায়ী উপার্জন নেই। তাছাড়া পরিবারও উদ্বিগ্ন, তারা একা একা মেয়েকে অত দূরের শহরে আর পাঠাতে রাজি নয়।
"আমি আবার পালালে, মা আমাকে অভিশাপ দেবেন। হাতে কোনো টাকা নেই- ব্যাংকের হিসাব শূন্য; গ্রামে করার মতো কোনো কাজও নেই।"
পুরো ভারত জুড়ে একই গল্প অগণিত নারীর। মহামারি চলাকালে বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রোসা আব্রাহাম কর্মসংস্থান বাজারের ২০ হাজার কর্মীর ভাগ্যবদলের ট্র্যাকরেকর্ড অনুসরণ করেছেন। এতে দেখা গেছে, প্রথম লকডাউনের পর পর নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি চাকরি হারাচ্ছিলেন। মহামারির বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর তাদের কাজে ফেরার সুযোগ বা সম্ভাবনাও পুরুষের চেয়ে বেশ কম।
লকডাউনের কালে নারীর কাঁধে গৃহস্থালি কাজের ভার বাড়ে অনেকগুণ। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং শিশু সেবার বিকল্প সুবিধা যেমন ডেকেয়ার সেন্টার না থাকায়- তাদেরকে সন্তান প্রতিপালনে আরও বেশি সময় দিতে হয়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে বিয়ের ঘটনা। চিরকাল এসব সমস্যা ভারতে নারী স্বাধীনতাকে খর্ব করলেও, মহামারি তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। সামাজিক এসব ঘটনা একসাথে মেলালেই নারীর এত পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি বোঝা যায়।
রোসা আব্রাহাম বলেন, "লকডাউনের সময় অর্থনৈতিক দুর্দশা সকলের হয়েছে। কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে তাদের অন্য কাজে যাওয়ার সুযোগ ছিল। নারীদের সামনে সে উপায়ও ছিল না। তাই তারা পুরুষের মতো শ্রমবাজারে টিকেও থাকতে পারেনি।"
রোসা জানান, এসময়ে অফিস ঘরে ভালো বেতনের চাকরি করার সুযোগ মিলিয়ে যায়, তার জায়গা করে নেয় নিরুপায় হয়ে করার মতো কর্মসংস্থান। নারীর জন্য যা ছিল মূলত বিনা পয়সায় পারিবারিক কৃষিখেত-খামারে সাহায্য করা, নাহয় গৃহস্থালি কাজ।
যদিও মহামারির আগেই পরিবারের সদস্যদের জন্য পুরুষের চেয়ে ১০ গুণ বেশি সেবামূলক কাজ করতেন ভারতীয় নারীরা, যা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি।
রোসা আব্রাহাম বলেন, "কোথায় তারা কাজ করবেন সে সিদ্ধান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর হাতে থাকে না, যা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।"
আর্থ-সামাজিক অবস্থার সংস্কৃতিও নারী কর্মী কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী। যেমন যেসব ভারতীয় পরিবার সম্পন্ন, তাদের অনেকেই বাড়ির মেয়েদের বাইরে কাজ করা পছন্দ করে না। এতে নিজেদের সামাজিক মর্যাদাহানি হয় বলে মনে করে তারা। অন্যদিকে, সমাজের দরিদ্রতম অংশে নারীদের এখনও সম্ভাব্য উপার্জনকারী হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু, আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে যোগদানের সুযোগ তাদেরও কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের করতে হয় বিনা-বেতনের না হয় ন্যূনতম মজুরির কাজ। তাই সরকারি পরিসংখ্যানে তাদের শ্রমকে গণনাও করা হয় না।
অনেক গ্রামে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ আজো কঠোরভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়। কন্যা শিশু কাঙ্ক্ষিত নয়। গর্ভে থাকা অবস্থায় লিঙ্গ শনাক্ত করে কন্যাশিশু গর্ভপাতের মাধ্যমে নষ্ট করে ফেলার চর্চা আজো প্রচলিত।লিঙ্গ-সমতার জন্য কাজ করা মুম্বাই-ভিত্তিক একটি সংস্থা আকশারা সেন্টারের জেষ্ঠ প্রকল্প পরিচালক আখিনা হাসরাজ বলেন, "স্ত্রীদের উপার্জন করাকে অনেক স্বামী তাদের পুরুষত্বের প্রতি অপমানজনক বলে মনে করেন।"
"তারা চান নারী নির্ভরশীল থাকুক। মানুষ মনে করে নারী শিক্ষিত হলে, কাজ করবে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে। তখন তারা পরিবারের কথা শুনবে না বা সম্মানও করবে না।"
বিয়ে ভারতীয় সমাজে এক সংবেদনশীল অধ্যায়। আজো বেশিরভাগ নারীর বিয়ে পারিবারিকভাবে নির্ধারিত হয়। ২০২০ সালে লকডাউন ঘোষণার পর ভারতের শীর্ষ ম্যারেজ সাইটগুলোতে নতুন রেজিস্ট্রেশনের হিড়িক পড়ে যায়। খোদ সরকারি তথ্যই বলছে, এসময়ে অনেক রাজ্যে বাল্যবিবাহ ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।
উত্তর ভারতের অনুপশহরে অবস্থিত পরদাদা পরদাদী এডুকেশননাল সোসাইটি নামক এক গার্লস স্কুলের শিক্ষক মধু শর্মা জানান, আগে তিনি বছরে তিনটি বাল্যবিবাহ ঠেকাতেন। মহামারির সময় স্কুল বন্ধ থাকার সময় এ সংখ্যা তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, "কোভিডের আগে সব সময় শিক্ষার্থীদের সাথে সব সময় শিক্ষকদের যোগাযোগ ছিল। লকডাউনের সময় তাদের সবার খোঁজখবর রাখাটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।"
মহামারিকালে বিয়ে বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল আর্থিক দিক। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও জনসমাগম নিষিদ্ধ থাকায় অনেক অভিভাবক প্রায় নীরবে ঘরোয়াভাবে দিয়ে দিয়েছে বাল্যবিবাহ। চরম অভাব থেকেও অন্নের মুখ কমাতে অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের বিয়ে দিয়েছে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ