মহানবী (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে কূটনৈতিক চাপে ভারত
মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের নবী মোহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দুই সদস্যের বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে ভারত সরকার।
কুয়েত, ইরান ও কাতার ইতোমধ্যে দেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে। সৌদি আরবও এক বিবৃতির মধ্য নিয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। এবার এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, ইরাক, মালদ্বীপ, জর্ডান, লিবিয়া ও বাহরাইনের নাম।
ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির দলীয় মুখপাত্র নুপূর শর্মা গত ২৬ মে একটি টিভি চ্যানেলে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। পরবর্তীতে দলের দিল্লি শাখার মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নিভিন জিন্দাল টুইটারে এ সংক্রান্ত একটি পোস্ট দেন।
দুজনের মন্তব্যের জেরে গত এক সপ্তাহ ধরেই ভারতীয় মুসলিমদের তোপের মুখে বিজেপি। ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমরা বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেছেন। কিন্তু তা নিয়ে দলটি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে সর্বশেষ মহানবীকে অবমাননার ঘটনাটি আরব বাণিজ্য সহযোগীদের নজরে পড়তেই বাড়তে থাকে অসন্তোষ। চাপের মুখে ২৪ ঘণ্টার মাথায় শাস্তিস্বরূপ বিতর্কিত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বিজেপি।
নুপূর শর্মাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। অন্যদিকে নভিন জিন্দালকে দল থেকেই বহিষ্কৃত করে বিজেপি। দুজনেই বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চান।
সমালোচকরা বলছেন, নুপূর ও নভিনের বক্তব্য বিগত বছরগুলোতে ভারতে বাড়তে থাকা অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় মেরুকরণেরই প্রতিফলন। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে উল্লেখযোগ্যভাবে মুসলিম বিদ্বেষ ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর আক্রমণ বাড়তে দেখা যায়।
দলটি ইতোমধ্যে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "বিজেপি যেকোনো ধর্মের যেকোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমানের তীব্র নিন্দা করে। কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মকে খাটো বা অপমান করে, বিজেপি এমন এমন যেকোনো মতাদর্শের বিরুদ্ধে। বিজেপি এমন ব্যক্তি বা দর্শনকে সমর্থন করে না।"
তব বিজেপির এই বিবৃতিতে পরিস্থিতি শান্ত হবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। অভ্যন্তরীণ ক্ষোভ এখন আন্তর্জাতিক অসন্তোষে রূপ নিয়েছে।
দীর্ঘসময় ধরেই ছড়ানো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি
হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতে মুসলিম বিদ্বেষ তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে সমালোচকদের মত। গত কয়েক সপ্তাহে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। শতাব্দী পুরনো প্রাচীন এক মসজিদে প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়ে বারানসির আদালতের দ্বারস্থ হয় কয়েকটি হিন্দু গোষ্ঠী। তাদের দাবি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর ওই মসজিদ নির্মিত হয়েছে।
এই ঘটনায় টিভি চ্যানেলগুলোয় উস্কানিমূলক বিতর্ক ও আলোচনা প্রচারিত হয়। ডানপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় বহু আলোচকই এই প্রসঙ্গ ঘিরে বিতর্কিত মন্তব্য করে। তবে সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি নুপূর শর্মার মন্তব্যকে 'বিচ্ছিন্ন' দাবি করলেও তা মোটেও বিজেপির মূলস্রোতের বাইরে থেকে আসা কোনো মন্তব্য নয়।
গত মাসের শুরুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির এক সদস্য উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাজমহলের 'বাস্তব ইতিহাস' খুঁজে বের করতে ২২টি তালাবদ্ধ দরজা খুলতে পিটিশন দায়ের করেন। মোগল যুগের এই সমাধি নাকি হিন্দু মন্দিরের ওপর নির্মিত, এমন দাবিও ওঠে।
১৯৯২ সালে ১৬ শতকে সম্রাট বাবরের সময় নির্মিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদীরা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে জায়গাটি নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট মন্দির নির্মাণের জন্য জমি হস্তান্তর করে। এরপরের বছর মোদি নিজেই এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেন।
এরপর থেকে আরও কয়েক ডজন মসজিদ নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন তুলেছে হিন্দত্ববাদীরা। বারানসি, মথুরাসহ মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন আদালতে এধরনের মামলা চলমান। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বিদ্বেষমূলক আক্রমণ এখন ভারতের প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে গান, কবিতা, সিনেমার মতো সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বিজেপি। মুসলিমদের প্রতি কটুক্তি, ঘৃণামূলক বক্তব্য এমনকি গণহত্যার হুমকি প্রদানের অসংখ্য বিবৃতি ও মিউজিক ভিডিও ইউটিউব ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চরমপন্থী হিন্দুদের মাঝে জনপ্রিয়।
বিজেপির বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা সিনেমার পৃষ্ঠপোষকতারও অভিযোগ রয়েছে। এর আগে এরকমই বিতর্কিত একটি ছবি 'কাশ্মীর ফাইলস'-কে উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে করছাড়ের সুবিধা দেওয়া হয়। সম্প্রতি আরেকটি ছবি 'সম্রাট পৃথ্বীরাজ'-ও করমুক্ত ঘোষণা করেছে বিভিন্ন রাজ্য যাতে মানুষ স্বল্প খরচে এ ধরনের ছবি দেখতে পারে।
তবে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ঘটনাগুলো নতুন না হলেও এবারই তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছে ভারত।
নয়াদিল্লির থিংক ট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো কবির তানেজা বলেন, "ভারত এই প্রতিক্রিয়ায় ধাক্কা খেয়েছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক ইস্যু নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে এর আগে আমরা এমন প্রতিক্রিয়া দেখিনি (আরব রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে)"।
বিভিন্ন দিক থেকে চাপের মুখে ভারত
বিশ্লেষকরা জানান, এ ঘটনায় ভারত আন্তর্জাতিকভাবে যেভাবে হিমশিম খাচ্ছে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত।
ভারতের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ক্ষমা দাবি করেছে কাতার। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে। "এ ধরনের ইসলামোফোবিক বা ইসলামবিদ্বেষী মন্তব্য করেও শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেলে তা মানবাধিকারের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং এর ফলে বিদ্বেষ ও মুসলিমদের কোনঠাসা করার ঘটনাও বৃদ্ধি পাবে। এরফলে ঘৃণা ও সংঘাতের চক্র তৈরি হবে।"
কাতারে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত দিপক মিত্তাল বলেন, এই 'বিচ্ছিন্ন মন্তব্য' ভারত সরকারের বক্তব্যকে প্রতিফলিত করে না।
৫৭টি মুসলিম দেশের জোট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি)-ও ভারতের সমালোচনা করেছে। তবে, দিল্লি ওআইসি ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা সমালোচনা করে বলে, 'তাদের মন্তব্য অনাকাঙ্খিত ও সংকীর্ণ মন-মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে'।
কতটুকু চাপে আছে ভারত?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার হয়তো বিজেপির শীর্ষ নেতা ও সরকারকে এ বিষয়ে প্রকাশ্য বিবৃতি দিতে হবে। আর তা না হলে সমগ্র আরব বিশ্ব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর জোট গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)-এর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ। কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ জিসিসির সঙ্গে ২০২০-২১ অর্থবছরে ভারতের ৮৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল।
লাখ লাখ ভারতীয় এসব দেশে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন যাদের থেকে ভারত কোটি কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে। ভারতের অধিকাংশ জ্বালানিও আসে এসব দেশ থেকে।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে নরেন্দ্র মোদি নিয়মিত এসব দেশে সফরে গেছেন। আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারত ইতোমধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। একইসঙ্গে জিসিসি-র সঙ্গেও বড় একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি আবুধাবিতে একটি হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সাড়া ফেলেন। ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের বাড়তে থাকা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিত্তিমূল হিসেবে তা বিবেচিত হয়।
গত দুবছরে আরব আমিরাতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলেও এরকম অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে আরব আমিরাতের অবস্থান বেশ গুরুত্ব বহন করে।
বিশ্লেষকদের বক্তব্য, এই সংঘাতের ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির জন্য ভারতকে বিশাল মূল্য চোকাতে হবে।
তেহরানের সঙ্গে বিগত বছরগুলোতে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হলেও নতুন এই বিতর্ক ইরানীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদোল্লাহিয়ানের ভারত ভ্রমণেও প্রভাব ফেলতে পারে।
আরব বিশ্বে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়াত। তার মতে, ভারত এখন এক কঠিন পরিস্থিতিতে রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল এই ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো সম্ভব হবে।
"ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ভারতীয় কর্মকর্তারা সাধারণত আত্মপক্ষ সমর্থনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখান। নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ক্ষেত্রেও তারা এই কাজ করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে ভারতীয় কূটনীতিকরা আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে দ্রুত উত্তেজনা কমিয়ে ক্ষতি কমানোর কৌশল অবলম্বন করবেন বলেই আশা করছি," বলেন উইলসন সেন্টার থিংক ট্যাংকের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান।
আরব দেশগুলো নিজ দেশের ক্ষুদ্ধ জনগণকে ঠাণ্ডা করতেও কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করছে। দেশগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতকে সমালোচনা করে হ্যাশট্যাগের ব্যবহার এখন তুঙ্গে। গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইতোমধ্যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে। কাতার ও কুয়েতে বেশ কিছু দোকান ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলেছে এমন সংবাদও সামনে এসেছে। কুয়েতের আল-আরদিয়া কোঅপারেটিভ সোসাইটি সুপার মার্কেটের একটি ছবিতে আরবিতে লেখা আছে, "আমরা ভারতীয় পণ্য সরিয়েছি।"
তবে কুগেলম্যানসহ বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, জনসাধারণের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়াকে একপাশে রাখলে জিসিসি ও ভারতের সম্পর্ক উভয় পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। দুপক্ষই ঝুঁকি এড়িয়ে দ্রুত সমঝোতায় আসার চেষ্টা করবে। আর তাই মুসলিম-বিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দেশগুলো খুব বেশিদূর যাবে না বলেও মনে করেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি ও সিএনএন