অন্য সিন্ডারেলা
মাঝে মাঝে তার মনে হয়, বেঁচে আছে, জীবন যাপন করেছে মাত্র কটা মুহূর্ত; আবার অন্য সময় মনে হয়, সে শতবর্ষী বুড়ি।
কখনো মনে হয়, সে বোধ হয় যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করবে, আবার মনে হয়, এখনো তার জন্মই হয়নি।
এই কক্ষটিতে সে স্থায়ীভাবে বন্দী, সব সময়ই সে আশা করে কেউ আসবে, এই কক্ষ-জরায়ু থেকে তাকে জন্ম দেবে। তারপরই সে ভাবে, আমাকে আর কে জীবন দিতে আসবে? আমার নিজেরই কিছু একটা করতে হবে। জীবদ্দশাতেই তাকে জরায়ুর বাইরে বেরোতে হবে।
আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে বাইরে তাকাল। দরজার ঠিক বাইরেই সেই নাদুসনুদুস রক্ত তৃষ্ণার্ত জন্তুটি ক্ষুধার্ত জিব বের করে হাঁপাচ্ছে।
তার মনে হলো অনন্তকাল ধরে জন্তুটি এখানে দাঁড়িয়ে। যখন সে তাড়াতে চেষ্টা করল, কুকুরটি তাকে লক্ষ্য করে ঘেউ ঘেউ করে উঠল, সামনের দুই পা এমন ভয়ংকরভাবে উঠিয়ে রাখল, দেখলেই ভয় লাগে। দুই পা পিছিয়ে এসে মেয়েটি দরজা বন্ধ করে দেয়। কুকুরের ঘেউ ঘেউ মাকে সজাগ করে দেয়, আবার তাহলে এই মেয়েটি একটা কিছু বদমায়েশি শুরু করতে যাচ্ছে।
মা তার মেয়েদের নিয়ে ফিরে আসে, কুকুরের পিঠ চাপড়ে দেয় আর ঘরে ঢুকে কোনো কথা না বলে মেয়েটিকে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। তার এই ঘর থেকে বেরোবার আগে তার বোনেরা প্যাঁচ লাগানো উলের একটি দলা তার দিকে ছুঁড়ে দেয়, মা গর্জন করে বলে ওঠে, যতক্ষণ উলের প্যাঁচ খুলতে না পারবি, মনে রাখিস, তোর খাবার বন্ধ থাকবে।
তার অশ্রু চোখেই শুকোয়। প্যাঁচ লাগা উলের জট খুলতে থাকে, কিছুক্ষণ পরপর চোখ তুলে জানালা দিয়ে খোলা আকাশের দিকে তাকায়।
এই মহিলা তার সৎমা আর মেয়েগুলো সৎবোন।
তার জন্মের সময়ই নিজের মা মারা যায় আর বাবার মৃত্যু হয় এক বছর পর। বাবা-মার কথা কদাচিৎ তার মনে আসে। তার চিন্তার দিগন্ত খুবই সীমিত। যে কক্ষে সে চোখ খোলে, তার বিশ্ব সেখানেই ঘুরপার খায়।
শৈশবের কথা মনে করে ভাবে, যে মহিলাটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে, সেই তার মা আর যে পুরুষটি তার মাথা সোহাগে-আলিঙ্গনে টেনে নিচ্ছে সে-ই তার বাবা। তারপর ধীরে ধীরে সেই হাসি ও আলিঙ্গন হারিয়ে যায় এবং সবকিছুতে আবার সৎমা, সৎবোন ও রক্তপিপাসু কুকুরের মূর্তি ভেসে ওঠে।
একবার জানালাপথে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু কেমন করে যমশত্রু ওই জন্তুটি টের পেয়ে যায়। যখনই সে জানালাতে পা রাখে, মুখের বাইরে বেরিয়ে আসা লকলকে জিবসহ কুকরটি হাঁপাতে হাঁপাতে ঠিক জানালার নিচে এসে দাঁড়ায়। তার চোখেমুখে হুমকি। অসহায় মেয়েটি আবার নেমে আসে, দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
কখনো জানালাপথে ছুড়ে মারা পাথরনুড়ি তার পায়ে এসে পড়ত। ওড়নার ভেজা প্রান্ত দিয়ে চোখ মুছে বুকের ভেতরের ঝড়ো তোলপাড় চেপে রাখে। তারপর নুড়িটা কুড়িয়ে ঘরে কোথায় অন্যান্য নুড়ির সঙ্গে রেখে দেয়। নিজেই নিজেকে ভাবায়, 'না, আমি আর ওই জানালার কাছে যাবই না।'
তারপরও অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সে দেয়ালের পেছনে এসে দাঁড়ায়, পাগলাটে লোকটি কী করছে দেখবে। রাস্তার পাশে সবুজ গাছের নিচে সবুজ শাল গায়ে চাপানো লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে, জানালার দিকে তার চোখমুখে হাসি।
সবুজ শাল গায়ে দেওয়া লোকটি আসলেই অদ্ভুত ধরনের। অনেকটা বামনাকৃতির, তার টেকো মাথা, ছোট চোখ এবং ধূসর বর্ণের দাড়ি। সবুজ গাছের নিচের জায়গাটা সোনালি 'মহুর' ফুলে ঢাকা।
কোকাকোলা খেতে খেতে তাগড়া, লম্বা ছেলেগুলো তাদের লম্বা চুল ও কোমর পিছলে পড়ে যাওয়া ট্রাউজার পরে সদর্পে পদচারণের সময় তাকে নিয়ে ঠাট্টামস্করা করত, তাকে লক্ষ্য করে বিড়াল ডাক দিত, পাথরও নিক্ষেপ করত। কিন্তু পাগলাটে লোকটি বিনিময়ে একটু কেবল হাসত।
তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে গিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে ছেলেরা তাকে একা ফেলে চলে যেত। কিন্তু মাঝে মাঝে খুব ক্ষেপে গেলে লোকটা আহত বাঘের মতো গননবিদারী হুংকার দেয়। শয়তান ছেলেগুলো তখন কোকাকোলার ক্যান ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
তারপর এই উন্মত্ত প্রেমিক আকাশ ফাটানো কণ্ঠে গান গাইতে শুরু করে। উলঙ্গ পেটফোলা বাচ্চাদের সে তার পাশে জড়ো করে, কোমরে প্যাঁচানো ব্যাগ থেকে মিঠাই বের করে, তারপর বাচ্চাদের মধ্যে বিতরণ করে। মেয়েটির শুকনো জিব, ঠোঁটের ওপর এপাশ-ওপাশ করে।
মেয়েটি ভাবে, 'সে নিজেই তো পাথর নিক্ষেপের শিকার, সে আমাকে সাহায্য করবে কেমন করে?'
সেই উন্মত্ত প্রেমিক বরাবরই সেখানে থাকে- এখন সে মেয়েটির প্রতিদিনকার জীবনের অংশ। লোকটি সম্পর্কে তার তেমন কোনো জ্ঞান নেই। কেবল জানে, লোকটির মাথা খারাপ, ছেলেরা তার ওপর পাথর ছোড়ে এবং সে শিশুদের মিঠাই দেয়। তার কণ্ঠ সুরেলা, তার হুংকারে শত বাঘিনীর শক্তি।
যখন অন্ধকার চারদিক থেকে এই মেয়েটিকে ঘিরে ফেলে, তার কক্ষে নিক্ষেপ করা একটা নুড়ি এসে ঠিক তার পায়ের পাতার ওপর পড়ে। বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া ঝড়টাকে সে চেপে রাখে।
না না! আমার জানালার কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।
সে আমাকে তার কাছে ডাকবে।
আমি যদি জানালার বাইরে পা রাখি, কুকুরটি কামড়ে আমাকে কিমা বানিয়ে ফেলবে।
কিন্তু জানালা পেরিয়ে সে-ই বা এখানে আসে না কেন?
আমার দুর্ভোগের কথা কতটা সে জানে? না, সে আসলে আমার ব্যাপারে তত আগ্রহী নয়; নাকি সে চায় উদ্যোগটা আমিই গ্রহণ করি? ঠিক আছে, আমি না হয় কোনোভাবে তার কাছে পৌঁছলাম, তাতে তফাৎটা কী হবে? সে তো মাথা খারাপ এক ভিক্ষুক। আমার মা ও বোনরা আমাকে যে জামা পরতে দেয়, তা-ই বা সে কোত্থেকে জোগাড় করবে?
আমি তো মিঠাই পছন্দ করি না।
'কিন্তু সে আসলে কে আর কেনই বা সে আমার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে?
সে যতই জানতে চাক না কেন, কিছুই তার জানা হয়নি, কোনো কথাই তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। কারণ, মা যে তার সৎমা, বোনেরা যে তার সৎবোন।
ভয়ংকর কুকুর সব দরজা পাহারা দিচ্ছে। কুকুর নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক। মেয়েটি যখন গোপনে চুরি করে কিছু খেতে চায়, অমনি কুকুরটা হাজির। বোনদের পোশাক চুরি করে এনে পরতে চায়, কুকুরের ভয়ে পারে না। এই বন্দিশালা থেকে পালাবার সব পথে বেরিয়ে আসা লকলকে জিব, জ্বলন্ত, নির্মম ও প্রতারণাপূর্ণ চোখ নিয়ে কুকুরটি দাঁড়িয়ে।
তার মা ও বোনেরা সব সময়ই ঝলমলে পোশাক পরা। অতিথিরা তাদের দেখতে আসে। প্রতি সন্ধ্যায় তারা কোনো না কোনো পার্টিতে যায়। কারও সঙ্গে দেখা করার অনুমতি তার নেই।
অতিথি আসার আগে সবকিছু ঘষেমেজে চকচকে রাখতে হয় তাকেই। ততক্ষণে তার মা ও বোনেরা পার্টির সাজ নিয়ে ব্যস্ত। যখন অতিথিদের হাসির প্রতিধ্বনি শোনা যায়, সে তখন রান্নাঘরে বাসন মাজে।
সবাই চলে গেলে সে ক্লান্ত হয়ে নিজের রুমে ফিরে আসে, একা বসে উলের জট খুলতে থাকে কিংবা অবচেতনভাবে নিক্ষিপ্ত নুড়ির অপেক্ষায় থাকে।
পৃথিবীর সেই শুরু থেকেই এটাই তার জীবন।
তারপর এক সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের মতোই মা ও বোনেরা নৈশভোজে যোগ দিতে যায়। নিজের রুমে বসে নিজেকে আনন্দে রাখতে মেয়েটি নুড়িগুলো গুনতে শুরু করে।
হঠাৎ তার ঝাপসা আলোর কক্ষটি উজ্জ্বল আলোতে ভরে যায়। এত আলো যে চোখ ঝলসে যাচ্ছে। কক্ষের বাইরে কি গাড়ির শব্দ? না, না, এটা তো হতে পারে না। সে নিজেকে টেনে ওঠায়, পড়ো পড়ো অবস্থায় জানালার দিকে এগোয়। তার বুক ধুকধুক করছে। তার চোখে পড়ে একটা বড় জমকালো চটকদার গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে। কালো স্যুট পরা এক সুদর্শন যুবক গাড়ি থেকে নেমে তার নেক-টাই ঠিক করতে করতে জানালার দিকে এগিয়ে আসে। জানালার পাশে তাকে লজ্জাকাতর দেখায়।
যুবক ফিসফিস করে বলে, তাহলে তুমিই সে মেয়ে।
'তুমি তাহলে এসেছ? আমি যে পৃথিবীর সূচনা থেকেই তোমার অপেক্ষায় আছি।'
মেয়েটি দেয়ালে মাথা এলিয়ে দেয়, চোখ বন্ধ করে। তারপর সে থমকে দাঁড়ায়, চারদিকে তাকায়। খোদাকে ধন্যবাদ, কুকুরটাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
'তুমি আছ তো?'
'হ্যাঁ', তার মুখ থেকে ছোট্ট শব্দটি বেরিয়ে যায়।
'বেশ।' সে জানালা ডিঙিয়ে ভেতরে আসে।
'না, না! এখান থেকে চলে যাও। আমার সৎমা আছে।'
'একটুও ভাববে না। তোমার সৎমা এখানে আসবে না। এখন এটা পরে ফেল, দেখি তোমাকে কেমন দেখায়।' যুবক হীরা বসানো একজোড়া জুতো বের করে দেয়।
'পায়ে দাও তো দেখি।' যুবক আদেশ করে। সে অনেকটা নিশ্চল হয়ে পড়েছে। তার কণ্ঠের আওয়াজে প্ররোচিত হয়ে সে জুতোয় পা গলিয়ে দেয়।
যুবক বলে, 'আজই ঠিক আছে। এগুলো তোমার জন্য।'
'আমার জন্য?'
'হ্যাঁ, তোমার। রাজপুত্রের নৈশভোজ থেকে পালানোর সময় তুমি ফেলে এসেছিলে?'
'হ্যাঁ, তুমি। তুমি হয়তো মনে করতে পারছ না যে এক পরি তোমাকে রাজপুত্রের প্রাসাদে নিয়ে গিয়েছিল। তুমি রাজপুত্রকে কথা দিয়েছিলে যে ...।'
'কিন্তু ওটা তো ছিল একটা স্বপ্ন।'
'ওটা স্বপ্ন, না অন্য কিছু, আমি জানি না। ওটা নিয়ে আলাপ করার ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়নি। চলে এসো, রাজপুত্র তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।'
তার হৃদয় নেচে ওঠে। হাজার বছর পর সেই দিনটি সত্যি সত্যি এসে পড়েছে, আর সে মুক্তি পেতে যাচ্ছে। আর সেই মুক্তিও এমনই গৌরবময় জাঁকজমকের সঙ্গে; স্বয়ং রাজপুত্রের মাধ্যমে। তার মা ও বোনেরা যখন ব্যাপারটা জানবে, নির্ঘাত ঈর্ষায় মারা যাবে। তবে এখনো সে তার সৌভাগ্য নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না।
'কিন্তু...।' সন্দিহান হয়ে সে একটা কিছু বলতে চাইল।
'কোনো কিন্তু নেই।' রাজপুত্র নিশ্চয়ই তোমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করবেন। তারপর তোমার বাকি জীবন কাটাবে গৌরবময় রাজপ্রাসাদে, যেখানে...।'
যুবক তার সামনে রাজপ্রাসাদের একটি চিত্ররূপ তুলে ধরে।
'এখন তাহলে চলো যাই।' যখন সে তার নোংরা পোশাকের দিকে তাকাল, যুবক বলল, চিন্তার কোনো কারণ নেই। রাজপুত্র তোমার জন্য যে পোশাক পাঠিয়েছে, তা গাড়িতে আছে।'
'কিন্তু কুকুরটা?' সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াল। যুবক হেসে উঠে জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে গেল। ইশারায় তার পায়ের দিকে দেখাল। রক্তপিপাসু শ্বাপদ জন্তুটা কুকুরের খাবার মজা করে খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে নিষ্পাপ মেষ।
যুবক আদেশ করল, 'এসো।'
স্বর্গের প্রত্যাশা নিয়ে সে জানালাপথে লাফিয়ে নামল। যুবক নিজ হাতে তার জন্য লিমুজিনের দরজা খুলে দিল। যেই না সে গাড়ির ভেতর ঢুকতে যাচ্ছে, একটি কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, 'যেয়ো না।'
বিস্মিত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখল লাল শাল গায়ে সেই পাগলটি সবুজ গাছটার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে আতঙ্কিত হলো এবং তাকে ওখান থেকে চলে যেতে বলল। পাগলা কেবল হাসল। তাকে হতোদ্যম দেখাচ্ছে।
সে যুবকের দিকে তাকাল। যুবক গাড়ির দরজা ধরে তখনো তার অপেক্ষায় সোজা দাঁড়িয়ে আছে। তার চক্ষু স্থির হয়ে আছে।
আরও একবার সে গাড়ির পা-দানির দিকে পা তুলল।
'যেয়ো না।' পাগল একই কথার পুনরাবৃত্তি করল।
'আমি রাজপুত্রের স্বর্গে যাচ্ছি।'
'কিন্তু তুমি আর ফিরতে পারবে না।'
'তাতে কী এসে যায়? সে খুব সুদর্শন, সে রাজপুত্র।'
'তাহলে আমার কথা শোনো, যখন সময় নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর পরের মুহূর্ত পুনর্জন্ম নেয় মৃত্যুর মুহূর্ত, তার আগেই তুমি আমার কাছে ফিরে এসো।'
সে হেসে ওঠে।
'আমি তোমার প্রতীক্ষায় থাকব।'
আরও জোরে হেসে উঠে, সে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
'পাগল।'
'কে পাগল?'
তুমি তাকে চেনো না।
গাড়ির পেছন দৃশ্য দেখার আয়নাতে যুবক দেখল পাগলটা আস্তে আস্তে সবুজ গাছে একটি সোনার মহর ফুলে রূপান্তরিত হয়েছে, মেয়েটির কক্ষ থেকে আবছা আলো এসে একে আরও সুন্দর করে সাজিয়েছে।
রাজপ্রাসাদ বহু জাতির বহু বর্ণের মানুষে ভরপুর।
নীল চোখ, সুন্দর শরীরে সামান্য দাগটিও নেই, সেই রাজপুত্র তাকে সম্ভাষণ জানাল, অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল।
সে যেন স্বর্গে আছে, পা তার মাটি স্পর্শ করছে না। ধীরে ধীরে সে তার শ্রবণশক্তি হারাল- সে শুনল, 'তারপর মৃত্যুর মুহূর্ত পুনর্জন্ম নেওয়ার আগেই ফিরে এসো।'
হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়ির দিকে সে তাকিয়ে আছে। বিরক্ত হয়ে রাজপুত্র তার ঘড়ি খুলে নিয়ে ছুড়ে ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে সেই কণ্ঠস্বর থেমে যায়।
'ধন্যবাদ!' বলে সে উচ্চস্বরে হাসিতে ফেটে পড়ে।
সোনার থালা থেকে খাবার তুলে নেয়, পান করে হীরকখচিত গ্লাসে। জীবনে এই প্রথম সে পেট ভরে খেল। সে খাওয়াতে এমনভাবে বসে রইল যে রাজপুত্র যখন তাকে তার সঙ্গে নাচতে বলল, উঠতে তার সমস্যাই হচ্ছিল।
নাচের প্রতি চক্করেই রাজপুত্র যখন তাকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে, সে যেন তখন উঁচু মেঘের মধ্য দিয়ে উড়ে চলে। নৈশভোজে আসা অন্য সব রাজকন্যা ক্ষোভে ফুঁসতে থাকে, তাকে অভিশাপ দেয়। নাচের এক চক্করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরার পর রাজপুত্র তাকে বেডরুমে নিয়ে আসে, বেডরুমে সুরের সমারোহ আগে থেকেই। ক্লান্ত দুজনই পালকের বিছানায় গড়িয়ে পড়ল।
স্বর্ণে ভরপুর একটি ট্রের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে রাজপুত্র বলল, 'এগুলো সবই তোমার।'
অর্ধনিমিলীত চোখে তাকিয়ে বলল, 'তাই।'
'এখন তোমার আর কোনো কিছুর অভাব থাকবে না।'
'হ্যাঁ নিশ্চয়ই। কারণ, এখন থেকে তুমিই আমার।'
এর মধ্যে কী ঘটল আল্লাহই জানেন, রাজপুত্র তার গলা টিপে ধরে ঝাঁকি দিল। হতচকিত মেয়েটি যখন দেখল রাজপুত্রের মুখ থেকে একটি একটি করে সব দাঁত ঝরে পড়ছে, সে ভয়ে অসাড় হয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়াল। রাজপুত্রের পাঠানো তার পোশাক তুলার উল দিয়ে তৈরি। রাজপুত্র উন্মত্তের মতো তা ছিঁড়তে শুরু করল। ভয়ে সে তার বাহুতেই সিঁটিয়ে রইল। ঠিক তখনই বেডরুমের ঘড়ি চিৎকার করে উঠল সময় থেমে গেছে...ফিরে এসো...পালিয়ে এসো...পরের মুহূর্তের নিশ্বাস নেওয়ার আগেই...।
রাজপুত্রের বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার দিকে তাকাল। কৃত্রিম চুলে তৈরি তার পরচুলা পড়ে গেছে, তার সেই নীল চোখ মনে হচ্ছে পাথুরে চোখ, ছেদন দাঁত কটা ছাড়া আর সব দাঁত পড়ে গেছে, সেই দাঁত রক্তমাখা। মোচড় দিয়ে সে তার মুষ্টি থেকে বেরিয়ে এল।
'তুমি এখান থেকে কেমন করে যাবে?'
রাজপুত্র প্রচণ্ড শব্দে হেসে ওঠে। ঘড়িরও চিৎকার ধ্বনি।
হাত দিয়ে নিজের গোপন অঙ্গ ঢেকে মেয়েটি দরজার দিকে ছুটল। স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দরজা খুলে গেল। সেখানে নিজেদের হীরকখচিত জুতো পায়ে তার মা ও বোনেরা দাঁড়িয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে হাসিতে ফেটে পড়ছে। সে অন্য দরজার দিকে দৌড়ায়। দ্বিতীয় দরজা, তৃতীয় দরজা, চতুর্থ দরজাÑসব দরজাতেই তাকে ধরার জন্য মা ও বোনেরা হাত বাড়িয়ে রেখেছে। উন্মাদিনীর মতো সে প্রাসাদের স্বর্গের ভেতর ঘুরছে আর ঘুরছে।
রাজপুত্রের হাসির নিনাদ এবং ঘড়ির বিকট চিৎকার তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর মেয়েটি নিজের গোপনাঙ্গ দুই হাতে ঢেকে কেবল ছুটছে আর ছুটছে।
- আনোয়ার সাজ্জাদ পাকিস্তানি নাট্যকার, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, কথক নৃত্যশিল্পী, কোরিওগ্রাফার, চিকিৎসক, টিভি চ্যানেল প্রধান এবং আগাগোড়া একজন বিপ্লবী। উপমহাদেশে প্রথম যাঁর নাটক টেলিকাস্ট হয়, তিনিই আনোয়ার সাজ্জাদ। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল জিয়াউল হককে নিয়ে ব্যঙ্গ নাটক লিখে সরকারের বিরাগভাজন হন। এম আসাদউদ্দিনের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় ভাষান্তরিত।